জয়নাল আবেদিন: নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণের জন্য অভিনব কৌশল নিয়েছে কিছু ব্যাংক। প্রভিশন সংরক্ষণে দুই থেকে ১০ বছর পর্যন্ত অতিরিক্ত সময় দেয়া হয়েছে। প্রতি বছর সমান ভাগে ভাগ করে এই বকেয়া প্রভিশন সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছে ব্যাংকগুলো। এর ফলে কমে এসেছে প্রভিশন সংরক্ষণে ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকের সংখ্যা। তারপরও এ বছর ৩১ মার্চ আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
কভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় ঋণ পরিশোধের বিশেষ সুবিধা তুলে নেয়া হয়েছে। আর তাতেই ব্যাংক খাতে ব্যাপকহারে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। ফলে পুরো ব্যাংক খাতই ঋণমান অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতিতে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩১ মার্চ আট ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। তবে কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসাবে রেখে দেয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমে গেছে।
সার্বিকভাবে মার্চ শেষে বাণিজ্যিক পুরো ব্যাংকে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতির পরিমাণ ১৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। গত ৩১ ডিসেম্বর সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সঞ্চিতি ঘাটতিতে থাকা আট ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি। এসব ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি হয়েছে ১৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। আর বেসরকারি খাতের রয়েছে চারটি, যেগুলোর সঞ্চিতি ঘাটতি তিন হাজার ৮২৩ কোটি টাকা।
২০২২ সালের মার্চ শেষে দেশে বিতরণ করা মোট ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যেক্ষেত্রে গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী, তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে সঞ্চিতি রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
আলোচ্য সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে মার্চ শেষে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের আট হাজার ১৩৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘাটতি বেসিক ব্যাংকের চার হাজার ১০৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি তিন হাজার ২২৫ কোটি ৪১ লাখ ও রূপালী ব্যাংকের এক হাজার ৫৭০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
অন্যদিকে বেসরকারিগুলোর মধ্যে মার্চ শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ১১১ কোটি ১০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৩১ কোটি ২৩ লাখ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৪৬ কোটি ৩১ লাখ ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২৩৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
২০২২ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৮৫ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়েছে ৭০ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। ফলে সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ১৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, সরকারি-বেসরকারিসহ সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, তার গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ (খেলাপি) ঋণে পরিণত হলে তাতে ব্যাংক যেন আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্য নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার বিধান রয়েছে।
কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বলছেন, সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা হয় মূলত আমানতকারীদের জমাকৃত অর্থের সুরক্ষা দেয়ার জন্য। কিন্তু যেসব ব্যাংক সঞ্চিতির কোটা পূরণ করতে পারেনি, সেসব ব্যাংকের আমানতকারীরা এখন ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ ব্যাংক কোনো কারণে খেলাপি হলে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া কঠিন হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের উদ্যোক্তারা সঞ্চিতি ঘাটতির সমান টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিলে জমা দেবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকে ঘাটতির টাকা জমা না দেয়া পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে চাপের মধ্যে রাখবে।
কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হলে সেই ব্যাংকের আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে লিখিত কোনো আইন পর্যন্ত নেই। এর সুযোগ নিচ্ছে অনেক ব্যাংক। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতাও বলা যায়। আর আইন না থাকায় দেউলিয়া কোনো ব্যাংকের আমান্যকারীদের অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য নয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য আমানত রক্ষায় আমানতকারীদের সজাগ থাকতে হবে। তবে তারা ব্যাংক সম্পর্কে তথ্য জানবেন কোথা থেকে। কারণ অনেক ব্যাংকের তথ্য আর বাস্তাবতার মিল থাকে না। এটা নিয়ে নতুন আইন করা প্রয়োজন বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র বলেন, ‘আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমানতের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। এটা করতে না পারলে আমানতকারীরা ঝুঁকিতে পড়েন।