আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৯,০৪৭ কোটি টাকা

রোহান রাজিব: খেলাপি ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে আটটি ব্যাংক। গত বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকে সরকারি-বেসরকারি আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। তবে কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করায় পুরো ব্যাংক খাতের ঘাটতি ১১ হাজার ৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকে আমানতের নিরাপত্তা কম। তাদের মতে, খেলাপি ঋণ, পুনঃতফশিল ও প্রভিশন ঘাটতি সমস্যা সমাধানে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা উচিত। ব্যাংকিং কমিশনের মাধ্যমে এর আগেও বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংক যেসব ঋণ দেয়, তার গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্য এ প্রভিশন সংরক্ষণের নিয়ম রাখা হয়েছে।

ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নি¤œ বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১১ হাজার ৭৭২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংকে ঘাটতি চার হাজার ৫৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে এ ঘাটতি ছিল চার হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি চার হাজার ৪২২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে ছিল তিন হাজার ৫২১ কোটি টাকা। সরকারি ব্যাংকের মধ্যে তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে রূপালী। দুই হাজার ৮১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকটি। সেপ্টেম্বরে রূপালির ঘাটতি ছিল তিন হাজার ১৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ব্যাংকটির ঘাটতি কিছুটা কমেছে।

বেসরকারি চার ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি সাত হাজার ২৭২ কোটি টাকা। নানা সমস্যায় জর্জরিত ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির অঙ্ক ছয় হাজার ৬১৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আগের প্রান্তিকের তুলনায় ঘাটতি কিছুটা কমেছে। সেপ্টেম্বর এ ঘাটতি ছিল সাত হাজার ৪৭৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ৩৪৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে ছিল ৩৪৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ঘাটতি ১৭১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে ছিল ১৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৩৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ ব্যাংকের সেপ্টেম্বরে ৪৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ঘাটতি ছিল। এছাড়া বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ তিন কোটি ৩৬ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৮৪ হাজার ১৫৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়েছে ৭৩ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম। ফলে ব্যাংক খাতের সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ১১ হাজার ৯ কোটি টাকা।

গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। তিন মাস আগে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এ হিসাবে আগের প্রান্তিকের তুলনায় সামগ্রিক ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমেছে ১৩ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা।

তবে ২০২১ সাল শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ঋণের যে চিত্র, এটা প্রকৃত চিত্র নয়। খেলাপি ঋণের সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। মূলত এটা একটা গাণিতিক হিসাব। শেষ প্রান্তিকে খেলাপি কমা মূলত ব্যালান্স শিট ভালো দেখানোর জন্য। এটা যদি সবসময় কমতে থাকে, তাহলে এ খাতের জন্যই ভালো।

তিনি আরও বলেন, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। ব্যাংক যদি প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার শঙ্কা থাকে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংকের ওপর। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় আমানত। ব্যাংক খাতে সমস্যা সমাধানে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা উচিত। ব্যাংকিং কমিশনের মাধ্যমে এর আগেও বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০