আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২৬ হাজার কোটি টাকা

রোহান রাজিব: ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন সংরক্ষণ বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। গত জুন শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংক বড় ধরনের নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিতে পড়েছে। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ১৩৪ কোটি টাকায়। মার্চ শেষে আট ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ২০ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৫ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা।

তবে কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম। জুন শেষে ব্যাংক খাতের সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ২১ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। তবে এ ঘাটতি মার্চের তুলনায় অনেক বেশি। মার্চ শেষে সার্বিক ঘাটতি ছিল ১৬ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি, বিদেশিসহ সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, সেগুলোর গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে আলাদা হিসাবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সে জন্য এ নিরাপত্তা সঞ্চিতির বিধান রাখা হয়েছে। ঋণের মান অনুযায়ী খেলাপি ঋণের বিপরীতে অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে শূন্য দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নি¤œ বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

সূত্র মতে, ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে তিনটি সরকারি ও পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক। গত জুন শেষে সরকারি তিনটি ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকায়। কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি রাখায় এসব ব্যাংকের সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকায়। অন্যদিকে বেসরকারি পাঁচটি ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৬১ কোটি টাকায়। এসব ব্যাংকের সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ২৬৬ কোটি টাকায়।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি ছিল অগ্রণী ব্যাংকের। গত জুন শেষে এ ব্যাংকের সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকায়। এরপর বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ৪ হাজার ৩১১ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৪ হাজার ৯৭ কোটি টাকা।

বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। জুন শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকায়। এছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ৫১৬ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংকের ৪৩৯ কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংক ৪১৯ কোটি টাকা এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২০৪ কোটি টাকা।

এদিকে সরকারের মেয়াদ যত ঘনিয়ে আসছে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। কারণ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ঋণ নিয়ে সময়মতো কিস্তি শোধ করছেন না। ফলে ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ দিনকে দিন শুধুই বাড়ছে। আর ঋণের টাকা ফেরত না আসায় ব্যাংকগুলো পড়ছে অর্থসংকটে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এই খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। আর ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। যদিও এক বছরের ব্যবধানে তা কিছুটা কম বেড়েছে। কারণ সাধারণত ডিসেম্বরে প্রভিশন ঘাটতি কমাতে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখায়। ২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান শেয়ার বিজকে বলেন, ডলার সংকটে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছে না। অনেকে প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে এসেও ফিরে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে এলসি খুলতে না পারলে ব্যবসায়ীরা কীভাবে ব্যবসা করবে। ব্যবসা করতে না পারলে তো ব্যাংকঋণ পরিশোধ করবে না। ঋণ পরিশোধ না করার কারণেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ফলে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। প্রভিশন ঘাটতি বাড়লে মূলধনে গিয়ে সরাসরি হিট করে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার রেট ছেড়ে দেয়া উচিত, যাতে ব্যাংকগুলো ডলারের কমিশন ব্যবসা করে প্রফিট করতে পারে। তা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এভাবে ট্রেজারি প্রধানদের জরিমানা করে মার্কেট পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০