Print Date & Time : 1 July 2025 Tuesday 3:42 am

আতঙ্কের নাম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানজট

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের অর্থনীতির লাইফ-লাইনখ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। এ মহাসড়কটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে। এ সড়ক দিয়ে দেশের আমদানি ও রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনারের ৭০ শতাংশ আনা-নেওয়া হয়। আর প্রতি মাসে প্রায় ৫০ লাখ যাত্রী পরিবহন করে বিভিন্ন পরিবহন সংস্থা। কিন্তু সম্প্রতি ঘন ঘন ও দীর্ঘ যানজট ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যবসায়ী ও যাত্রীদের। আর প্রতিনিয়ত বাড়ছে আর্থিক লোকসান।
সূত্রমতে, গত সপ্তাহের রোববার রাত সাড়ে ৮টা থেকে কুমিল্লাার দাউদকান্দি উপজেলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৩৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে মেঘনা-গোমতী সেতুর টোলপ্লাজা থেকে বেকিনগর পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার ও মেঘনা সেতু থেকে দাউদকান্দি সেতু পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার এলাকায় তীব্র যানজট দেখা যায়। এ যানজটের প্রভাব সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত ছিল। পরে তা আরও বেড়ে ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। মহাসড়কের এ অংশে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সময় লেগেছে কমপক্ষে দশ ঘণ্টা আর সর্বোচ্চ ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত। এতে চরম ভোগান্তিতে পারেন যানজটে আটকে পড়া যাত্রীরা।
গত মঙ্গলবার দুপুরে ফেনীর ফতেহপুর রেল ওভারপাসের দুটি লেন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ায় ফেনীতে জট কমে গেলেও মহাসড়কের ঢাকামুখী দাউদকান্দি অংশে নতুন করে যানজট বাড়তে শুরু করেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অত্যধিক পরিবহন, যানবাহনের ওজন নিয়ন্ত্রণ, টোল আদায় ও চলাচলের পাসিং জটিলতা, মেঘনা টোলপ্লাজা, ফোর লেন টু টু লেন, বিভিন্ন পয়েন্টে সিগন্যাল, ওভারটেকিং টেন্ডেসি, ফিটনেসবিহীন গাড়িসহ বিভিন্ন কারণে এখানে যানজট নিয়মিতই লেগে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি ফেনীর যানজটটি আরও প্রকট হওয়ায় যানজটে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা, আর তা সামাল দেওয়াই এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার পরিবহন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনার পরিবহনের ক্ষেত্রে সড়কের ব্যবহার ৯৬ শতাংশের বেশি। আর নামমাত্র হচ্ছে রেলপথ ও নদীপথ ব্যবহার। অথচ বন্দর দিয়ে যত কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়, তার ৭০ শতাংশ আনা-নেওয়া হয় ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চল থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ পণ্য আনা-নেওয়া হয় চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকা থেকে।
এ হিসেবে, কনটেইনার পণ্যের বড় অংশই পরিবহন হতো রেলপথ কিংবা নদীপথে। কিন্তু গত কয়েক দশকে অবকাঠামোগত সক্ষমতা বৃদ্ধি না পাওয়া এবং ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহে বেড়েছে সড়কনির্ভরতা। এতে বাড়ছে খরচ। বাড়ছে যানজট ও ভোগান্তি। যদি সড়কনির্ভরতা কমানো যেত, একদিকে দেশের সড়ক-মহাসড়কের স্থায়িত্ব বাড়ত, অন্যদিকে সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে সরকারের ব্যয় কমত। অথচ এসব কনটেইনারে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত প্রায় আট হাজার ট্রেইলর ও প্রাইম মুভারের কাছে বিভিন্ন সময়ে জিম্মি হয়ে পড়ে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। এই গাড়িগুলো জাহাজ থেকে আমদানি পণ্যভর্তি কনটেইনার দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন এবং রফতানি পণ্যভর্তি কনটেইনার জেটি পর্যন্ত পৌঁছানোর কাজটি করে থাকে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, গত ১ ডিসেম্বর কার্যকর করা হয় এক্সেল লোড নীতিমালা। এর আওতায় নির্ধারিত সীমার বেশি পণ্য পরিবহনে শাস্তির বিধান রাখা হয়। ফলে লোড পর্যবেক্ষণের সময় ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়। তবে এ নীতিমালা বাতিল করার জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে জোর তদবির করছেন ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিকরা। কারণ অনুমোদিত সীমায় পণ্য পরিবহনে রাজি নন ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিকরা। এজন্য এক্সেল লোড নীতিমালা বাতিল করার জন্য চলছে নানামুখী তৎপরতা।
আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় সড়কপথে পণ্য পরিবহনে খরচ বেশি। সড়কপথে প্রতি কনটেইনার পণ্য পরিবহনে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়। রেল ও নৌপথে সড়কের তুলনায় পরিবহন ব্যয় অর্ধেকের বেশি কমে যায়। তবে সড়কপথে খরচ বেশি হলেও সময় কম লাগে। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় সড়কপথে ১০-১২ ঘণ্টায় পণ্য আনা-নেওয়া করা যায়। রেলপথে সময় লাগে ২৩ থেকে ২৪ ঘণ্টা। এর আগে কনটেইনার পরিবহনের আগে সিরিয়াল পেতেই সময় লেগে যায় কয়েক দিন। নৌপথে এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সূচি নেই। ফলে পণ্য নিয়ে উপেক্ষা আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়।
রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে যানজটের এই অবস্থা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের জন্য। রমজান ও ঈদে বাড়ি ফেরার বাড়তি চাপ প্রতিবছরই সরকারকে ভোগায়। এবার সেই ভোগান্তিতে যুক্ত হতে যাচ্ছে নতুন যানজটের মাত্রা। এই মাত্রাকে সামাল দিয়ে নির্বিঘেœ মানুষের বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা দেওয়াই এখন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন অনেকেই। আর নির্বাচনি বছরে সরকারও মানুষের ঈদযাত্রা আনন্দদায়ক না হলেও যেন কষ্টদায়ক না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দেবে বলেও মনে করছেন সবাই।
হাইওয়ে পুলিশ জানায়, যানবাহনগুলো দ্রুতগতিতে গোমতী, মেঘনা ও কাঁচপুর ব্রিজের কাছে এসে জড়ো হয়ে মেঘনা ও গোমতীর টোল প্লাজায় সারিবদ্ধ হয়। এরপর সেতুতে ওঠার সময় যানবাহনের গতি অন্তত ৮০ ভাগ কমে যায়। চার লেনের গাড়িগুলো দুই লেনের সেতুতে ধীর গতিতে চলায় যানজট দেখা দেয়। এছাড়া দাউদকান্দির টোল প্লাজায় একসঙ্গে এত যানবাহনের ওজন নিয়ন্ত্রণ, টোল আদায় ও চলাচলের পাসিং দেওয়া যাচ্ছে না। তাই যানজট দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হাইওয়ে পুলিশ কাজ করছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের কারণে আমরা ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। পণ্য পরিবহনে এখানে ব্যয় বাড়ছে কেজিতে তিন টাকা করে, যা দেশের সাধারণ জনগণকে বহন করতে হচ্ছে। সড়কপথে পণ্য পরিবহনের অত্যধিক নির্ভরতার জন্য তিনি বলেন, মূলত অবকাঠামোগত সংকটের কারণে কনটেইনার পরিবহনে সড়কনির্ভরতা বেড়েছে, যা অনেক সময় ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। আর প্রতিবছর যে হারের আমদানি ও রফতানি বাড়ছে, সেই হারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমাদের এখনও সুযোগ আছে পরিকল্পিতভাবে রেলপথ ও নদীপথ ব্যবহারের। এ জন্য রেলওয়েকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
সাম্প্রতিক আলাপকালে চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (পরিকল্পনা ও প্রশাসন) জাফর আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হলে পণ্য পরিবহনে সড়কপথের ওপর নির্ভরতা কমাতেই হবে। কিন্তু রেলপথের সীমাবদ্ধতায় পণ্যের পরিবহন বাড়ানো যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে রেলওয়ে কনটেইনার পরিবহনে একটি কোম্পানি গঠন প্রস্তাবনায় ছিল। এটি যদি দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে সবার জন্য ভালো। আর বন্দরসহ যৌথ উদ্যোগে এ কোম্পানি গঠন করা যায়। অন্যদিকে নৌপথে কনটেইনার পরিবহন বাড়াতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’