আতঙ্কে কমেছে ব্যাংক আমানত

রোহান রাজিব : ব্যাংক খাতের আমানত কমেছে। মূল্যস্ফীতির পর এবার প্রভাব পড়েছে ব্যাংক খাতের অনিয়মের ঘটনা। বিদায়ী বছরের শেষের দিকে দেশের কিছু ব্যাংকের অনিয়মের চিত্র বের হয়। এসব ঘটনা সামনে আসার কারণে মানুষ আতঙ্কে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। অন্যদিকে আস্থাহীনতার কারণে মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখছেন না। ফলে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে আমানত কমেছে তিন হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। তবে এ সময়ে ঋণ ও বিল ১৭ হাজার ৯২১ কোটি টাকা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে, তাই মানুষকে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে এ খরচ মেটাচ্ছেন। আবার কেউ সঞ্চয় করতে পারছেন না। ফলে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়েছে ব্যাংক আমানতে। তবে এর বাইরে যোগ হয়েছে কিছু ব্যাংকের অনিয়ম। অনিয়মের চিত্র সামনে আসার ফলে মানুষ আতঙ্কে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। নতুন করে কেউ ডিপোজিট করছে না। এ খাতে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ব্যাংক আমানত ছিল ১৪ লাখ ৯০ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। তা নভেম্বর মাসে কমে ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে মোট আমানত কমেছে ৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা বা শূন্য ২১ শতাংশ। এর মধ্যে চাহিদা আমানত বাড়লেও মেয়াদি আমানত কমেছে। এক মাসে মেয়াদি আমানত কমেছে ৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে চাহিদা আমানত বেড়েছে ১ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি কমতে পারে, তবে মোট আমানত কমে যাওয়া অস্বাভাবিক বিষয়। এটা ব্যাংকিং খাতের জন্য অশুভ সংকেত। কিছু কিছু ব্যাংকের অনিয়মের কারণে এ খাতে মানুষের একটা অস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। মানুষ টাকা জমা করার চেয়ে উঠাচ্ছে বেশি। তাই ব্যাংক আমানত কমেছে।

তিনি আরও বলেন, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদাসীনতার কারণে এ সংকট তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের সঠিক প্রয়োগ করেনি। ব্যাংকিং খাতে যেসব অনিয়ম হচ্ছে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্ট কিছু বলছে না। এসব কারণে এখানে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এখনই এর সমাধান না করলে ভবিষৎতে সংকট আরও গভীর হবে।

অন্যদিকে ব্যাংক আমানত কমলেও ঋণ ও বিল বেড়েছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এসে ঋণ ও বিল ১৪ লাখ ৩৪৫ কোটি টাকা ছিল। নভেম্বর মাসে তা বেড়ে ১৪ লাখ ১৮ হাজার ২৬৬ কোটি টাকায় ওঠে। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ঋণ ও বিল বেড়েছে ১৭ হাজার ৯২১ কোটি টাকা।

এ বছরের এপ্রিল মাস থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। আবার মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে ১০৭ টাকায় উঠেছে, যা এক বছর আগেও ছিল ৮৫ টাকা। এতে আমদানি খরচ অনেক বেড়েছে। ফলে ব্যাংকের ঋণ ও বিল বৃদ্ধি পেয়েছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি আনিস এ খান শেয়ার বিজকে বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। তাই মানুষের আগের তুলনায় খরচ বেশি হচ্ছে। এজন্য মানুষের হাতে টাকা বেড়ে গেছে। তাই দিন শেষে বা মাসের শেষে তার আয়ের একটি অংশ আর ব্যাংকে জমা রাখছেন না।

তিনি আরও বলেন, অনিয়মের কারণে ব্যাংক খাতের ওপর আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এর একটা প্রভাবও লক্ষ করা যায়। সাধারণত গ্রামের মানুষ বেশি উদ্বেগজনক। তাই তারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। ফলে ব্যাংক খাতের আমানত কমছে।

এদিকে ব্যাংক খাতের বাইরে মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের অক্টোবর শেষে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৩৬ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ৫২ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে নগদ অর্থ বেড়েছে ১৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।

অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যতেও প্রভাব পড়েছে। এক মাসে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ১৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর হাতে সিআরআর ও এসএলআর রাখার পর গত ২০২২ সালের নভেম্বরে অতিরিক্ত তারল্য কমে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। অক্টোবরে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য ১৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, দেশে অধিক মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকের আমানতের ওপর একটা প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। সঞ্চয় করার সক্ষমতা নেই। ব্যয় যতটা বেড়েছে, আয় ততটা বাড়েনি। তাই মানুষ সঞ্চয় থেকেও ভেঙে খাচ্ছেন। ফলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি ব্যাংক খাতে অতিমাত্রায় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এমন একটি ব্যাংকের কাছ থেকে ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, যেটা সবচেয়ে বড় একটি ব্যাংক। এসব ঘটনার কারণে ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। এজন্য মানুষ আতঙ্কিত হয়ে টাকা তুলে ফেলছে। যার প্রভাব পড়েছে ব্যাংক আমানতে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০