নিজস্ব প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারের মতো ব্যাংক খাতেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সে কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছে। এটি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। তিনি বলেন, একটি বেসরকারি ব্যাংক (ফারমার্স ব্যাংক) খারাপ অবস্থায় পড়েছে। ব্যাংকটির কারণে এমনটি করা ঠিক হবে না। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ঋণের সুদহার না বাড়ানোরও তাগিদ দেন তিনি।
গতকাল শনিবার রাজধানীর হোটেল লা মেরিডিয়ানে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের বার্ষিক ব্যবসায়িক সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান, অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত, কাশেম হুমায়ূনসহ বিভিন্ন পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামস উল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী হোসেন প্রধানিয়া এবং অগ্রণী ব্যাংকের ডিএমডি, জিএম ও শাখা ব্যবস্থাপকরা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ব্যাংকারদের প্রধান কাজ কেওয়াইসি (নো ইউর ক্লায়েন্ট) পদ্ধতি পরিপালন করা। আপনি কাকে ঋণ দিচ্ছেন তাকে আগে চেনেন। এমনকি যার মাধ্যমে প্রকল্পের প্রস্তাব আসছে তাকেও চেনেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো প্রকল্পে ঋণ দেয়া যাবে না। ব্যাংকে একটি গোষ্ঠী থাকা দরকার, যারা প্রকল্প যাচাই-বাছাই করবে। তিনি আরও বলেন, সর্বত্র ব্যাংকিং সেবা ছড়িয়ে দিতে হলে ব্যাংকের শাখা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ফারমার্স ব্যাংকের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, একটি বেসরকারি ব্যাংক খারাপ অবস্থায় পড়েছে। পুঁজিবাজারে প্যানিক ছিল। এখন সেটা ব্যাংকিং খাতেও চলে আসছে। সে কারণে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিচ্ছে। তিনি অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে এটি বন্ধ করার আহ্বান জানান। অনেক বেসরকারি ব্যাংক আগ্রাসী ব্যাংকিং করেছে।
ঋণ আমানতের অনুপাত বা এডিআর নিয়ে তিনি বলেন, এডিআর সীমা লঙ্ঘন করে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করেছে বেশ কিছু ব্যাংক। সেটি কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে। তা পুরো ব্যাংক খাতকে প্রভাবিত করার কথা নয়। কারণ ১১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে মাত্র চার ব্যাংকের রয়েছে ছয় হাজার কোটি টাকা। এগুলো হলো-বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। বাকি পাঁচ হাজার কোটি টাকা অন্যন্য ব্যাংকের। এসব ঋণ ফেরত আনতে হবে।
তিনি বলেন, এডিআরের কারণে আমানতের সুদহার বেড়েছে। একই সঙ্গে খরচ বেড়ে যাওয়ায় ঋণের সুদহারও বাড়াচ্ছে কেউ কেউ। অন্তত রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক যেন ঋণের সুদহার না বাড়ায়। কারণ ঋণের সুদহার বাড়ালে ব্যবসার জন্য ভালো হবে না। এটি দেশের জন্যও ভালো হবে না বলে মনে করেন গভর্নর।
অগ্রণী ব্যাংকের বেশকিছু সূচকে অগ্রগতির প্রশংসার পাশাপাশি নেতিবাচক সূচকের সমালোচনা করেন গভর্নর ফজলে কবির। তিনি বলেন, আমানত এখনও ৫০ হাজার কোটি টাকার ওপরে রয়েছে। এডিআর বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। গভর্নর বলেন, আমদানি বেড়েছে অনেক। কিন্তু সে তুলনায় রফতানি ও রেমিট্যান্সের হার বাড়েনি। ৮২ শতাংশ কু-ঋণ ফেরত আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তিনি বলেন, লোকসানি শাখা অনেক কমলেও এখনও ৪৩টিতে অবস্থান করছে। ২০১৮ সালের মধ্যে এটি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার কথা বলেন তিনি। এছাড়া বিচারাধীন মামলা কমাতে হবে। নিয়ম মেনে ঋণ দিতে হবে। বড় প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। নন ফান্ডেড ঋণ যেন দ্বিগুণ ঋণ বা ফোর্সড লোনে রূপ না নেয় সেদিকে খেয়াল রাখার কথা মনে করিয়ে দেন গভর্নর।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, এটা স্বীকার করতেই হবে যে, ব্যাংক খাত নিয়ে যথেষ্ট অস্বস্তি রয়েছে। এ খাত নিয়ে অনেক জবাবদিহিতা করতে হয়। বিশেষ করে নির্বাচনী এলাকায়। সরকারি ব্যাংকের সেবা নিয়ে তিনি বলেন, বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় সরকারি ব্যাংকের সেবা অনেক দুর্বল।
ব্যাংকারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সরকার যা দিচ্ছে তার অনুপাতে ফেরত পাচ্ছে কম। ব্যাংকারদের ন্যয়কে ন্যয় এবং অন্যায়কে অন্যায় বলতে হবে। তিনি বলেন, পুরস্কারের গতি বেশি। কিন্তু তিরস্কারের গতি শ্লথ। দুটো গতির অনুপাত সমান হওয়া উচিত।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান বলেন, বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঋণ (এলটিআর) এবং ঋণপত্র খোলাসহ (এলসি) বিভিন্ন মাধ্যমে অনিয়ম করা হয়েছে। বড় ঋণ আদায় হচ্ছে না। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের ঋণ সব চেয়ে কম আদায় হচ্ছে। এগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। সরকারি ব্যাংকের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
তিনি বলেন, বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় সরকারি ব্যাংকের সেবারমান খুবই দুর্বল। এ ব্যবধান কমাতে হবে। ঋণ বিতরণের পদ্ধতিতে অনেক সমস্যা। আজ সব খারাপ কথা বলব না। একসঙ্গে এত খারাপ কথা হজম করতে পারবেন না বলে জানান অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই আর্থিক খাত সচিব।
অনুষ্ঠানে ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালকরাও বক্তব্য রাখেন। এমডি ব্যাংকটির বিভিন্ন সূচকের উন্নতির কথা তুলে ধরেন।