বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ বিশ্ব মিডিয়ায় যেমন ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল, এ-সংক্রান্ত একটি মামলা কানাডার আদালতে খারিজ হওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে একই পরিস্থিতি। উল্লেখ্য, ওই অভিযোগকে নিতান্ত গালগল্প বলে অভিহিত করা হয়েছে আদালতের রায়ে। অনেক বিশেষজ্ঞ এরই মধ্যে মন্তব্য করেছেন, এতে আইনি লড়াইয়ে পরাজয় ঘটেছে বিশ্বব্যাংকের। উত্থাপিত অভিযোগের ব্যাপারে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি সংস্থাটি। ওই রায়ে সংবাদমাধ্যমের ব্যাপারে আদালত বিশেষ কোনো পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন কি না, আমরা জানি না। তবে এর মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমেরও এক ধরনের নৈতিক পরাজয় যে ঘটেছে, তা বলা বাহুল্য।
অনেকের হয়তো মনে আছে, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক যখন প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করবে কি না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করছিল, তখন দেশীয় প্রায় সব সংবাদমাধ্যমেই এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল গুরুত্বসহকারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই রকম পরিস্থিতি লক্ষ করা গিয়েছিল কিছু বিদেশি সংবাদমাধ্যমে। সংবাদমূল্য বিবেচনায় এমন ট্রিটমেন্ট যথাযথ ছিল, সন্দেহ নেই। তবে তাতে যে সাংবাদিকতার নীতি অনুসরণে কিছুটা হলেও ঘাটতি ছিল, এটা এখন স্পষ্ট। বস্তুত তখন অভিযোগ বা পাল্টা অভিযোগ নয়, সংবাদ পরিবেশনে মাধ্যমগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় জোর দিলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো বলে মনে হয় না। তখন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেমন প্রশ্নের মুখে পড়েছিল এবং এখন বিশ্বব্যাংককে যে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে, এগুলো এড়ানো যেতো সহজে। বড় কথা, বিশ্বব্যাংককে রাখা গেলে অর্থায়নকারী অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকেও রাখা যেতো এ প্রকল্পে। তাতে এর সুফল ভোগ করতো বাংলাদেশের মানুষ।
প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাংবাদিকতার বিস্তারই শুধু ঘটায়নি, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সহায়কও হয়েছে। ওই সময় পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন কিন্তু তেমন চোখে পড়েনি। বরং বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যকে সত্য হিসেবে প্রমাণ করার বিরামহীন প্রচেষ্টা দেখা গেছে কারও কারও মধ্যে। বলা বাহুল্য, এ কারণে তখন অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় সরকারকেও। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, সাংবাদিকতার এ ধারা অনুসরণ করা কি অসম্ভব ছিল? পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, এখন বিশ্বব্যাংকের বিচার চাইছেন কেউ কেউ। ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়েও এগিয়ে এসেছেন অনেকে। ভুলে গেলে চলবে না, পদ্মা সেতু থেকে সরে গেলেও অন্যান্য প্রকল্পে সংস্থাটি বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন এবং এখানকার দারিদ্র্য উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সে সময় এ দেশের ব্যাপারে তার মধ্যে যে ইতিবাচক মনোভাব দেখা গেছে, তাও মনে রাখা দরকার। আদালতের রায় পক্ষে আসায় বাংলাদেশের ব্যাপারে সংস্থাটির নীতিনির্ধারকদের মনোভাব আরও ইতিবাচক করার ক্ষেত্রে তা ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাংলাদেশের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিঃসন্দেহে। এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের যে দুর্বলতা লক্ষ করা গেলো, ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না। প্রত্যাশা করি, কানাডার আদালতের রায়ের পর পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে নতুন করে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তা দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমের নীতিনির্ধারকদের আত্মসমালোচনায় যেতে সাহায্য করবে। এটা মনে রাখা জরুরি, সংবাদমাধ্যমের কাছে মানুষ শুধু ঘটনার বিবরণ নয়, ঘটনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা আশা করে। এটা সাহায্য করে তাদের মত ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে। বস্তুত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা জোরদার হলে দুর্নীতিবাজদের সাহসও কমে যায়। জনসচেতনতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিরোধ করা যায় অনেক অন্যায়। নিকট অতীতে রিজার্ভের অর্র্থ চুরিসহ আরও কিছু বড় ঘটনা আমরা দেখেছি। এসবের ব্যাপারে জনসাধারণ এখনও অন্ধকারে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন অসম্ভব নয়। আমরা চাই, সহযোগী সব প্রতিষ্ঠান বিশেষত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোয় এ ধারার সাংবাদিকতা চর্চায় এগিয়ে আসুক। সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে উন্নত স্বদেশ সৃজনের লক্ষ্যেই আমাদের এ আহ্বান।
Add Comment