মো. মিঠুন: আত্মহত্যার দায় কি শুধু আত্মহননকারীর একার? এ দায় কি আমাদের সমাজ ও সমাজের মানুষের তৈরি করা কিছু সমাজ ব্যবস্থার ওপরেও বর্তায় না? প্রতিটি মানুষ তার জীবনকে ভালোবাসে, নিজের সবটুকু দিয়ে হলেও স্বপ্ন বুনে ও আগামী সুন্দর জীবন রচনার চেষ্টা করে। কিন্তু সমাজপতিদের কিছু তথাকথিত নিয়মের বেড়াজালে বন্দি হয়ে অনেকেই নিজের স্বপ্নগুলোর গলা টিপে আত্মহত্যার মতো মহাপাপ করতেও দ্বিধা করে না। পত্রপত্রিকায় হরহামেশাই আমরা অনেকের, বিশেষত তরুণদের, আত্মহত্যার খবর দেখতে পাই। কিন্তু কেন একুশ শতকে এসেও আমাদের তরুণ সমাজ আত্মহত্যার দিকে পা বাড়াচ্ছে? আমরা কি কখনও তার সঠিক তথ্য খুঁজে পেয়েছি? একজন মানুষ কেন আত্মহত্যার মতো একটি পথ বেছে নিয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলছে, তা আমাদের গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখতে হবে।
ক’দিন আগেই আমরা দেখেছি মা-বাবার প্রতি অভিমান করে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা, নেত্রকোনার মদনে ধর্ষণের শিকার হয়ে তৃতীয় শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা এবং মধ্য বয়সী একজন ব্যবসায়ী নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ সবগুলোর জন্য কিন্তু আমরাই দায়ী। আমাদের আধুনিক সমাজব্যবস্থা দায়ী। একটা সময় ছিল যখন পরিবার-পরিজন নিয়ে মানুষ সুখে শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করত। মানুষের মাঝে অভিযোগ কম ছিল। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় আমরা এতটাই যান্ত্রিক হয়ে গেছি, সেখানে টাকা উপার্জন ছাড়া আর কিছুরই স্থান নেই। নিজেদের পরিবার-পরিজন-আত্মীয়স্বজন এমনকি নিজের প্রিয় সন্তানকে দেয়ার মতো গুণগত সময় মা-বাবার হয়ে ওঠে না। সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কোন বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, তা অনেক মা-বাবাই জানেন না।
আত্মহত্যাকে শুধু সামাজিক ব্যাধি বলে চালিয়ে দিলে চলবে না। দেশে বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে আত্মহত্যা। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে বেশ কিছু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি। পারিবারিক কলহ, প্রেমঘটিত জটিলতা, বেকারত্ব, পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল, নিঃসঙ্গতা, মানসিক চাপ, তীব্র বিষন্নতা, নিজের প্রতি পরিবারের অবহেলা ইত্যাদি কারণে অনেকেই আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিয়েছেন। অনেক মা-বাবা কন্যাসন্তানের তুলনায় ছেলেসন্তানকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন; যার ফলে মেয়ে সন্তানটি হীনমন্যতায় ভুগে, নিজেকে মূল্যহীন মনে করে এবং শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে ছেলে সন্তানটি দীর্ঘ পড়াশোনা শেষে পছন্দসই চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। অনেক মনে করেন মানসিক চাপ বা ডিপ্রেশনের কারণেই দিন দিন তরুণদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। ডিপ্রেশন বা মানসিক চাপ, যাই বলি না কেন এটি মূলত পারিবারিক ও সামাজিকভাবে আমাদেরই তৈরি। ছেলেমেয়ের মধ্যে বিভেদ করাটা যেমন পরিবার বা সমাজ থেকে আসে তেমনিভাবে পড়াশোনায় প্রথম সারির বা সেরা চাকরিতে সুযোগ পাওয়ার চাপটাও কিন্তু পরিবার ও সমাজ থেকেই তৈরি হয়।
বর্তমান সময়ে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছে যাচ্ছি। কিন্তু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত হওয়া অনেক বেশি জরুরি। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সফলতা অর্জনও অসম্ভব। পাশাপাশি মানসিক চাপের ফলে আত্মহত্যার পরিমাণও বাড়তে থাকবে।
মানসিক সমস্যাকে আমাদের দেশে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় বহুকাল আগে থেকেই। অনেকেই তার সন্তান বা পরিবারের সদস্যের মানসিক সমস্যার কোনো লক্ষণ থাকলেও তাদের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে সংকোচ বোধ করেন। একদিকে যেমন সঠিক তথ্য ও সচেতনতার অভাবে এমনটি ঘটে, তেমনি মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিতে গেলেই সমাজের মানুষজন ‘পাগল’ আখ্যা দিয়ে দেয় এবং সেই পরিবারটির জীবনধারণ কষ্টদায়ক করে তোলে। ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
করোনাকালে আমাদের দেশে মানসিক সমস্যা ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে, যা এখনও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে যতটা তৎপরতা দেখা গেছে মানসিক সমস্যার কারণ চিহ্নিত ও দূরীকরণে ততটা গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রায় ৯০ লাখের বেশি মানুষ আমাদের দেশে বিষণœতায়, এক কোটির মতো হতাশায় মানুষ এবং ১০ হাজারের মতো মানুষ প্রতি বছর আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করেন। এ পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় আমাদের দেশে মানসিক সমস্যার ভয়াবহতা কতখানি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জনগণের মানসিক সমস্যা নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা যায়, মোট ২৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বিষণœœতা ও হতাশায় ভুগছেন। যার মধ্যে ২৩ শতাংশ ছেলে ও ৩৩ শতাংশ মেয়ে। শারীরিক স্বাস্থ্য সুবিধাকে সরকার তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে পিছিয়ে আছে বহুগুণে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কিছু অনতিবিলম্বে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। করোনার সময়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা তাদের কৈশোরকালীন ও বয়োঃসন্ধিকালীন মানসিক সমস্যাগুলো নিয়ে বিদ্যালয়ের কাউন্সিলরদের পরামর্শও গ্রহণ করতে পারেনি। এ সময় শিক্ষার্থী নানা ধরনের মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। কমিউনিটি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়মিত ও প্রয়োজনীয় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে জনসচেনতা গড়ে তোলা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পেইন, বিশেষত মিডিয়ায় নিয়মিত প্রচারণা আবশ্যক। শারীরিক স্বাস্থ্যের ন্যায় মানসিক স্বাস্থ্যকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্য খাতকে অন্তর্ভুক্ত করে সমন্বয় করতে হবে। পাশাপাশি পরিবার থেকেই নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি নিশ্চিত করে বৈষম্যরোধে সচেষ্ট হতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে আন্তঃমন্ত্রণালয় একটি সমন্বয় থাকা অত্যন্ত জরুরি। মানসিক স্বাস্থ্য ও শারীরিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খেলাধুলা ও সামাজিকীকরণ উভয় ক্ষেত্রে খেলার মাঠ-পার্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেলার মাঠ-পার্ক সিটি করপোরেশনের আওতাধীন। সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখা সম্ভব।
বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় মানে শুধুই চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যয়। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে অর্থাৎ শারীরিক কার্যক্রমের সুযোগ তৈরি, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে কোনো ব্যয় সে অর্থে নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেভাবে চিকিৎসাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে, সেখানে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ ও সম্ভাবনা দুটোই কম। এমন একটি প্রতিষ্ঠান গঠন প্রয়োজন, যার কাজই হবে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে ভূমিকা পালন। সংস্থাটি বিশুদ্ধ পানি, নির্মল বাতাস, পরিবেশ, মাটি, খাদ্য, বাসস্থান, উš§ুক্ত স্থান, ব্যায়াম, স্যানিটেশন, হাঁটাচলা, খেলাধুলার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন নামে পরিচিত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। দেশে স্বাস্থ্য উন্নয়নে ‘হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা পালন সম্ভব।
উন্নয়ন কর্মী
mithun.00714@gmail.com