আদানির বিদ্যুতের দাম পড়বে প্রতি ইউনিট ১৮ টাকা!

ইসমাইল আলী: ১৬ ডিসেম্বর ভারত থেকে আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর কথা রয়েছে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে এ চুক্তি সই হয়েছিল। কয়লাচালিত ওই তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ। যদিও এজন্য গুনতে হবে উচ্চ হারে ক্যাপাসিটি চার্জ। এমনকি কয়লার মূল্যও ধরা হয়েছে দেশের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশি। এতে আদানির বিদ্যুৎ কেনায় খরচ পড়বে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়ের প্রায় তিনগুণ।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে গড়ে ব্যয় হয় ছয় থেকে সাড়ে ছয় টাকা। তবে আদানির বিদ্যুৎ কিনতে খরচ হবে প্রতি ইউনিটে প্রায় ১৮ টাকা।

পিডিবির তথ্যমতে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ভারতের ঝাড়খন্ডে গড্ডা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে আদানি। এ কেন্দ্রটি থেকে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। তবে ডিসেম্বর থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ৭২৫ মেগাওয়াট। আগামী জুন বা জুলাই থেকে পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করবে ভারতের এ গ্রুপটি।

চলতি অর্থবছর আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহের সম্ভাব্য পরিমাণ ধরা হয়েছে ২৯৮ কোটি ৭০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি বাবদ বিল গুনতে হবে চার হাজার ৭৯ কোটি টাকা আর ক্যাপাসিটি চার্জ এক হাজার ২৫৯ কোটি টাকা।  অর্থাৎ মোট ব্যয় হবে পাঁচ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে আদানির বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি ইউনিটের দাম পড়বে ১৭ টাকা ৮৭ পয়সা।

এদিকে ভারত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি রয়েছে। গত অর্থবছর বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় ৭৬৪ কোটি ৪০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি বাবদ বিল গুনতে হয় দুই হাজার ১৬৪ কোটি টাকা আর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় দুই হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় পড়ে চার হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ছয় টাকা ১১ পয়সা।

চলতি অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সম্ভাব্য পরিমাণ ধরা হয়েছে (আদানি ছাড়া) ৮২৪ কোটি ৬০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি বাবদ বিল গুনতে হবে দুই হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা আর ক্যাপাসিটি চার্জ দুই হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় হবে পাঁচ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ আমদানিতে (আদানি ছাড়া) ব্যয় পড়বে ছয় টাকা ৪১ পয়সা।

সূত্র জানায়, ভারতের আদানির কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে বাংলাদেশ সরকারকে ২৫ বছরে গুনতে হবে ১১ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান বিনিময় হার (১০৫ টাকা) ধরলে এ বাবদ খরচ পড়বে এক লাখ ১৫ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। এ অর্থ দিয়ে কমপক্ষে তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। ওই ক্যাপাসিটি চার্জ কর্ণফুলী টানেলের মোট বাজেটের ৯ গুণ অথবা ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণব্যয়ের চারগুণেরও বেশি। ‘আদানি গড্ডা কোল পাওয়ার প্লান্ট: অ্যান অ্যাকিলিস হিল অব দ্য পাওয়ার সেক্টর অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

গত জুনে প্রতিবেদনটি যৌথভাবে প্রকাশ করে বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনাবিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি) ও ভারতীয় গ্রোথওয়াচ। প্রতিবেদনে বলা হয়, আদানি গ্রুপ প্রতি বছর কমপক্ষে ৪২ দশমিক ৩৩ কোটি ডলার ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে নিয়ে যাবে। এ হার দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। আর আদানির গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের দাম প্রতি বছর কমপক্ষে পাঁচ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে বাড়বে। এতে ২০৪৭ সালে আদানির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বেড়ে দাঁড়াবে (বর্তমান বিনিময় হারে) ৩৬ টাকা ৪১ পয়সা।

অন্যদিকে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার দামও পড়বে বেশি। সূত্রমতে, পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনা হচ্ছে প্রতি টন ২৩৭ ডলারে। তবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনায় দাম পড়বে প্রতি টনে ৪৩৪ ডলার। মূলত কয়লার দামে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনা না করায় বেশি দাম দিতে হবে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য মাসে ৬০০ কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার আশঙ্কা করছে পিডিবি। আর বছরে গচ্চা যাবে প্রায় সাত হাজার ২০০ কোটি টাকা।

আদানির বিদ্যুৎ কেনার বিরোধিতা করে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় উদ্বৃত্ত রয়েছে। চাহিদা না থাকায় নিজস্ব বেশকিছু কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে। তাছাড়া ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি (গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল) সরবরাহ করতে না পারায় বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অথচ আদানির বিদ্যুতের দাম দিতে হবে ডলারে। এ অবস্থায় অস্বাভাবিক দামে আদানির বিদ্যুৎ আমদানির কোনো মানেই হয় না। এটা সরাসরি বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। তাই এ প্রক্রিয়া থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়, সে চেষ্টা করা উচিত।

যদিও আদানির বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি বাতিলের কোনো সুযোগ এ মুহূর্তে নেই বলে মনে করেন বিদ্যুৎ খাতের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসেইন। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ আমদানিতে আদানির সঙ্গে আন্তর্জাতিক চুক্তি করা হয়েছে। তাই চাইলেও এটি বাতিল বা সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই।

উল্লেখ্য, গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দিল্লিতে এক বৈঠকে আদানি গ্রুপের কর্ণধার গৌতম আদানি প্রতিশ্রুতি দেন আসন্ন বিজয় দিবস (১৬ ডিসেম্বর) থেকে গড্ডার বিদ্যুৎ বাংলাদেশে রপ্তানি শুরু হবে। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে গড্ডাতে চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০