আদানির বিদ্যুতে শুল্ক-করের অনিয়ম খুঁজতে কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিতে শুল্কসংক্রান্ত বিষয়গুলো কীভাবে সম্পাদন করা হয়েছে, তাতে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, শুল্ক পরিহার বা প্রত্যাহারের বিষয় রয়েছে কি নাÑএমন আরও প্রশ্ন সামনে রেখে তদন্তে নামছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
এজন্য আট কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের আদেশ জারি হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক এদিপ বিল্লাহকে। এতে একজন সদস্য সচিব ও ছয়জনকে সদস্য রাখা হয়েছে। অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুনমুন আকতার দিনার সই করা আদেশটি হাতে পেয়েছে শেয়ার বিজ।

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলম এই কমিটি অনুমোদন করেছেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑউপ-পরিচালক মুনমুন আকতার দিনা, রাজস্ব কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক ভূঁইয়া, রাজস্ব কর্মকর্তা পলাশ কুমার মল্লিক, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবুল কাশেম ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাহেদ হাসান লিমন। কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে এই অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমানকে। আগামীকাল রোববার থেকে শুরু হচ্ছে কমিটির তদন্তকাজ।

প্রসঙ্গত, গত ১১ জুন শেয়ার বিজে ‘চুক্তিতে অবৈধভাবে অব্যাহতি: শুল্ক-কর ছাড়াই ভারত থেকে আসছে আদানির বিদ্যুৎ!’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গত বছর এপ্রিল থেকে আদানির বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ৩১ শতাংশের বেশি শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হবে। তবে আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে কোনো ধরনের শুল্ক-কর দেয়া হচ্ছে না। ২০১৭ সালে সম্পাদিত চুক্তিতে অবৈধভাবে শুল্ক-কর অব্যাহতি দেয় পিডিবি। এতে বড় অঙ্কের রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ২০১৪ সালের এক প্রজ্ঞাপন অনুসরণ করে ২০২২ সালে আদানির বিদ্যুতের ক্ষেত্রে শুল্ক-কর অব্যাহতি চায় পিডিবি। পরবর্তী সময়ে এনবিআরের অনুমতি চেয়ে চিঠি দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। এনবিআরের অনুমতি ছাড়া আদানির সঙ্গে চুক্তিতে কীভাবে শুল্ক-কর অব্যাহতি দেয়া হলোÑতার ব্যাখ্যা চেয়ে একাধিকবার বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে এনবিআর। তবে এক বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও এনবিআরের চিঠির কোনো জবাব দেয়নি বিদ্যুৎ বিভাগ। এ অবস্থায় আদানির সঙ্গে হওয়া বিদ্যুৎ চুক্তিতে শুল্ক-কর বিষয়ে অনিয়ম রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে মাঠে নামছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় আমলে নেয়া হবেÑজানতে চাইলে এদিপ বিল্লাহ বলেন, ‘আমরা প্রথমেই আদানির সঙ্গে হওয়া চুক্তিটি দেখব, কী ছিল এখানে। এরপর দেখব বিদ্যুৎ আমদানি হতো কোন কোন শুল্ক স্টেশন দিয়ে এবং সে ক্ষেত্রে তাদের ডিক্লারেশন (ঘোষণা) কী ছিল। যে এইচএস কোডের মাধ্যমে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে, সেটি কাস্টমস আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, সেটিও দেখা হবে বলে তথ্য দিয়েছেন কমিটির এই আহ্বায়ক।’

এদিপ বিল্লাহ বলেন, চুক্তি দিয়ে শুরু করব। কারণ এ ক্ষেত্রে কাস্টমস আইন পরিপালন সঠিকভাবে হয়েছে কি না, দেখার আছে। আজ থেকে কমিটির কাজ শুরু হবে। কমিটি কার্যপরিধির বিবরণ অনুযায়ী, আদানির বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের নির্ধারিত মূল্য এবং তাতে শুল্ক-কর প্রযোজ্য কি না, সেটি যাচাই করা; এ পর্যন্ত আমদানি করা বিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শুল্ক-করের পরিমাণ কত এবং তা পরিশোধ করা হয়েছে কি না, এসব খতিয়ে দেখবে কমিটি। আমদানি করা বিদ্যুতের শুষ্ক-কর মওকুফ-সংক্রান্ত কোনো চুক্তি ছিল কি না; থাকলে এ বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন বা আদেশ জারি হয়েছে কি না, এটিও তদন্ত করবে কমিটি।
কোন কাস্টম হাউস বা স্টেশন দিয়ে এবং কী প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে এবং আলোচ্য পণ্যের শুল্কায়ন-সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য এনবিআর থেকে কোনো দপ্তরকে দায়িত্ব দেয়া আছে কি না, এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হবে বলে জানাচ্ছেন এদিপ বিল্লাহ।

যদি অন্য কোনো বিষয় থাকে, যেটি শুল্ক-করের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তাও খতিয়ে দেখার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে কমিটিকে। এসব বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে কমিটিকে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কাজের সুবিধার জন্য প্রয়োজন হলে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে কমিটিকে। প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর বিদ্যুৎ বিভাগ ও ‘আদানি পাওয়ার’-এর মধ্যে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি হয়। আদানি পাওয়ার হলো বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের আদানি গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। চুক্তির আওতায় বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিতে ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে আদানি পাওয়ার।

আদানির বিদ্যুৎ দেশে এনে জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে বিশেষ সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ অংশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়ায় দুটি সাবস্টেশন ও অন্যান্য সঞ্চালন স্থাপনা নির্মাণ করেছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। আদানি পাওয়ারের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভারতের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে আয় হয়েছে সাত হাজার ৩৭০ কোটি রুপি বা প্রায় ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করে এক হাজার ৪৬৮ কোটি রুপি, দ্বিতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দুই হাজার ৩৪ কোটি রুপি, তৃতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এক হাজার ৮২৪ কোটি রুপি ও চতুর্থ প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দুই হাজার ১৪৪ কোটি রুপি।

বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ওপর ৩১ দশমিক ০৭ শতাংশ হারে শুল্ক-কর প্রদান করলে এক বছরে এনবিআরের প্রায় তিন হাজার ২৩ কোটি টাকা শুল্ক-কর আদায় হতো। তবে অবৈধভাবে অব্যাহতির ফলে এনবিআর এ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০