রেন্টাল-কুইক রেন্টাল থেকে ক্রমেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ। বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে উৎপাদনে আসছে আরও তিনটি কেন্দ্র। সম্প্রতি এক বৈঠকে এ পাঁচটি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়, যা শেয়ার বিজের হাতে এসেছে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে তৃতীয় পর্ব
ইসমাইল আলী: কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে পায়রা উৎপাদন শুরু করেছে ২০২০ সালে। গত মাসে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে রামপাল কেন্দ্রটি। কয়েক মাসের মধ্যে আরও তিনটি কেন্দ্র উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রায় একই মানের কয়লা ব্যবহারের কথা থাকলেও দামের মধ্যে রয়েছে অস্বাভাবিক পার্থক্য। এর মধ্যে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার দাম ধরা হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির কেন্দ্রে কয়লার দাম ধরা হয়েছে প্রায় ৪২ শতাংশ বেশি। এতে মাসে গচ্চা যাবে প্রায় ছয় কোটি ৪০ লাখ ডলার বা ৭০০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে আদানির প্রতিনিধির সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ করে পাঁচ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয়ের হিসাব দেখানো হয়। এক্ষেত্রে প্রতি কেন্দ্রের সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার (৮৫ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর) ধরে ব্যয় হিসাব করা হয়েছে।
প্রথম পর্ব পড়ুন :
পিডিবির তথ্যমতে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানিকৃত কয়লার দাম ধরা হয়েছে প্রতি মেট্রিক টন ২৪৫ ডলার। এক্ষেত্রে প্রতি কেজি কয়লার ক্যালোরিফিক ভ্যালু (তাপন ক্ষমতা) ধরা হয়েছে চার হাজার ৬০০ কিলোক্যালরি। একই মানের কয়লা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কেনা হচ্ছে প্রতি মেট্রিক টন ২৫৪ দশমিক ৩৮ ডলারে। এছাড়া বরিশাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এ কয়লার দাম ধরা হয়েছে প্রতি মেট্রিক টন ২৬০ ডলার, বাঁশখালী এসএস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ২৭০ ডলার ও আদানির জন্য ৩৪৭ ডলার।
এ হিসাবে পায়রার বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির কেন্দ্রে কয়লার দাম বেশি ধরা হয়েছে প্রতি মেট্রিক টনে ১০২ ডলার বা ৪১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আর বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করলেও আদানির কেন্দ্রে কয়লার দাম বেশি ধরা হয়েছে প্রতি মেট্রিক টনে ৭৭ ডলার বা ২৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহারের (৮৫ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর) ভিত্তিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির ব্যয়ও বৈঠকে তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়বে ১৩ টাকা ৮৯ পয়সা, বরিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৪ টাকা ৫৭ পয়সা, রামপালে ১৫ টাকা দুই পয়সা, বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৫ টাকা ৩৭ পয়সা ও আদানির ১৯ টাকা ৬২ পয়সা। অর্থাৎ পায়রার তুলনায় আদানির জ্বালানি ব্যয় বেশি পড়ছে ৫ টাকা ৭৩ পয়সা বা ৪১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এদিকে পায়রার সঙ্গে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার দামের তুলনামূলক বিশ্লেষণ নিয়ে পৃথক আরেকটি হিসাব বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। এতে দেখানো হয়, নিউক্যাসেল কোল ইনডেক্স অনুযায়ী গত ডিসেম্বরে কয়লার দাম ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৪০৪ ডলার। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে মানের কয়লা কেনা হচ্ছে, তাতে প্রতি মেট্রিক টনে ৪৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। চুক্তিমতে, প্রতি টন কয়লার দাম ১১০ ডলারের বেশি হলে বাড়তি দামের ৫৫ শতাংশ পরিশোধ করতে হয় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে।
পায়রার এ চুক্তির শর্ত দেশের অন্যান্য কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে আদানির সঙ্গে ২০১৭ সালে সম্পাদিত চুক্তিতে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনা করা হয়নি। এতে চুক্তির ভুলে আদানির কয়লার জন্য পুরো দামই পরিশোধ করতে হবে। এতে চার হাজার ৬০০ কিলোক্যালরি তাপন ক্ষমতার কয়লায় মাসে গচ্চা যাবে প্রায় ৬৪ মিলিয়ন ডলার বা ৬৮৪ কোটি টাকা (এক ডলার = ১০৬.৯৫ টাকা)।
দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন :
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরকারের দেয়া বাড়তি সুবিধা এখানেই শেষ নয়। চুক্তির ভুলে আরও সুবিধা পাবে আদানি। এক্ষেত্রে যদি আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ দিতে প্রস্তুত থাকে, তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) কোনো কারণে চাহিদা দিয়েও সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ না কেনে, তবুও আদানি কয়লার পুরো মূল্যই পাবে। তবে দেশীয় অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো শর্ত রাখা হয়নি।
আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির কপি খুঁজে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। চুক্তির ১৩.১-এর (জি) ধারার (৪) উপধারায় এ-সংক্রান্ত শর্ত রয়েছে। এতে দেখা যায়, ৮৫ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে (পূর্ণ ক্ষমতা) যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিপেনডেবল ক্যাপাসিটি ৭০ শতাংশ থাকে, তবে পিডিবি যদি ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ কেনে তাহলে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ কয়লার দাম পরিশোধ করতে হবে। আবার ৬০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে (অপূর্ণ ক্ষমতা) যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিপেনডেবল ক্যাপাসিটি ৭০ শতাংশ থাকে তবে পিডিবি ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনলে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কয়লার দাম পরিশোধ করতে হবে।
শেষ পর্ব পড়ুন :
আরো পড়ুন :