ইসমাইল আলী: দেশের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। গত বছর ডিসেম্বরে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। আর চলতি বছর এপ্রিলে প্রথম ইউনিট উৎপাদন শুরু করে ভারতের ঝাড়খণ্ডে নির্মিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লাভিত্তিক এ তিনটি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে কম উৎপাদন ব্যয় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। দেশের তিনটি বৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় (এনার্জি চার্জ) বিশ্লেষণ করেছে পিডিবি। এতে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত পায়রা, রামপাল ও আদানির বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের তুলনা দেখানো হয়েছে। এতে দেখা গেছে, প্রতি মাসেই সবচেয়ে কম উৎপাদন ব্যয় (এনার্জি চার্জ) ছিল পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এর মধ্যে কোনো মাসে রামপাল বা আদানির চেয়ে পায়রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন ব্যয় কম ছিল। এক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি চার্জ বিবেচনা করা হয়নি।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাঁচ মাসের মধ্যে (এপ্রিল-আগস্ট) প্রতি মাসে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় কমেছে। এপ্রিল মাসে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ ব্যয় ছিল আট দশমিক ১৭ ইউএস সেন্ট। পরের (মে) মাসে তা কমে দাঁড়ায় সাত দশমিক ৫৯ সেন্ট। জুনে তা আরও কমে দাঁড়ায় সাত দশমিক ১৫ সেন্ট। পরের দুই মাসে পায়রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরও অনেক কমে যায়। এর মধ্যে জুলাইয়ে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় পাঁচ দশমিক ৯৪ সেন্ট ও আগস্টে পাঁচ দশমিক ২৭ সেন্ট।
সূত্রমতে, পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। এর মালিকানায় যৌথভাবে রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনের ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন লিমিটেড (সিএমসি)। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে দুই কোম্পানি সমান ১০ শতাংশ হারে মোট ২০ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। বাকিটা চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনে শুরু করে ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি। ওই বছর ৮ ডিসেম্বর উৎপাদনে আসে দ্বিতীয় ইউনিট। নির্ধারিত সময়ের আগে ও নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে কমে এ কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ২০২২ সালের ২১ মার্চ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। কেন্দ্রটি থেকে নিয়মিত এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছে সরকার। কয়লা সংকটে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০ দিন বন্ধ ছিল। তবে উৎপাদন শুরুর পর থেকে কারিগরি কোনো ত্রুটির জন্য এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি একবারও বন্ধ হয়নি।
পিডিবির তথ্য বলছে, অপর দুই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন ব্যয় (এনার্জি চার্জ) বিভিন্ন সময় ওঠানামা করেছে। এর মধ্যে কখনও রামপালের উৎপাদন ব্যয় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ছিল। আবার কোনো মাসে আদানির কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ছিল। এছাড়া আদানির দুই ইউনিটে দুই রকম বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ছিল।
পাঁচ মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় ছিল এপ্রিলে ৯ দশমিক ৮৭ সেন্ট, মে মাসে আট দশমিক ৪২ সেন্ট, জুনে আট দশমিক ৩৩ সেন্ট, জুলাইয়ে সাত দশমিক ৭৪ সেন্ট এবং আগস্টে পাঁচ দশমিক ৯৩ সেন্ট। অর্থাৎ রামপালের তুলনায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের এনার্জি চার্জ এপ্রিলে ছিল ২০ দশমিক ৮১ শতাংশ কম, মে মাসে ১০ দশমিক ৯৪ শতাংশ কম, জুনে ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ কম, জুলাইয়ে ৩০ দশমিক ৩০ শতাংশ কম এবং আগস্টে ১২ দশমিক ৫২ শতাংশ কম।
অন্যদিকে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউনিটপ্রতি ব্যয় ছিল এপ্রিলে আট দশমিক ৫১ সেন্ট। মে মাসে কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটে গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল আট দশমিক ৫৪ সেন্ট ও দ্বিতীয় ইউনিটে আট দশমিক ৫৪ সেন্ট। জুনে প্রথম ইউনিটে গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল সাত দশমিক ৭৫ সেন্ট ও দ্বিতীয় ইউনিটে সাড়ে সাত সেন্ট। জুলাইয়ে এ কেন্দ্রটির দুই ইউনিটে গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ছয় দশমিক ৭৮ সেন্ট ও আগস্টে ছয় দশমিক ৮৭ সেন্ট।
এ হিসাবে আদানির তুলনায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের এনার্জি চার্জ এপ্রিলে ছিল চার দশমিক ১৬ শতাংশ কম, মে মাসে ১১ দশমিক ৭৩ থেকে ১২ দশমিক ৫২ শতাংশ কম, জুনে চার দশমিক ৯০ থেকে আট দশমিক ৩৯ শতাংশ কম, জুলাইয়ে ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ কম এবং আগস্টে ৩০ দশমিক ৩৬ শতাংশ কম।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় (এনার্জি চার্জ) কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের এনার্জি চার্জ কম হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ কম মূল্যে কয়লা সংগ্রহ করা। কয়লা কেনার উৎস থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছানো পর্যন্ত যে ব্যয় হয় তা রামপাল ও আদানির চেয়ে পায়রায় অনেক কম।
উৎপাদন ব্যয় কম হওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্লান্ট ফ্যাক্টর বেশি হওয়া, যন্ত্রপাতির অধিক দক্ষতাও উৎপাদন ব্যয় কম হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দক্ষতা তুলনামূলক বেশি। তাই শুরু থেকেই পায়রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কম হচ্ছে। এটাকে ধরে রাখার জন্য সব রকমের চেষ্টা চলছে। আগামীতেও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
প্রসঙ্গত, গত এপ্রিলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্লান্ট ফ্যাক্টর ছিল ৭১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। অথচ ওই মাসে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্লান্ট ফ্যাক্টর ছিল ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ ও আদানির কেন্দ্রে ৩৯ দশমিক ৪২ শতাংশ।
দেশের দ্বিতীয় কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর উৎপাদন শুরু করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি, যা মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট নামে পরিচিত। ওইদিন এর ইউনিট-১ থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ যোগ হয়। গত ১ নভেম্বর এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিট উদ্বোধন করা হয়। তবে কারিগরি ত্রুটির কারণে প্রথম ইউনিটটি এ পর্যন্ত চারবার বন্ধ হয়েছে। এছাড়া কয়লা সংকটেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটটি চার দফা বন্ধ থাকে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। বাংলাদেশের পিডিবি ও ভারতের জাতীয় তাপবিদ্যুৎ করপোরেশন (এনটিপিসি) এর ৫০ শতাংশ করে শেয়ারের মালিক। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ঠিকাদার কোম্পানি ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড (ভেল)। আর এটি নির্মাণে ঋণ দিয়েছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক।
অন্যদিকে গত ৪ এপ্রিল আদানির ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট আনুষ্ঠানিক উৎপাদন শুরু করে। আর দ্বিতীয় ইউনিটটি ২৬ জুন থেকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে পিডিবির সঙ্গে আদানি পাওয়ার লিমিটেডের চুক্তি সই হয়েছিল।