জয়নাল আবেদিন: অর্থঋণ আদালতে আটকে আছে ব্যাংকের প্রায় এক লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। বহু চেষ্টা করেও টাকাগুলো আদায় করা যাচ্ছে না। আদায় না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, আদালত থেকে স্থগিতাদেশ ও আইনজীবীর অভাব অন্যতম। এতে করে মামলাগুলোর পেছনে ব্যাংকের যেমন ব্যয় হচ্ছে, তেমনি ব্যবস্থাপনায় সৃষ্টি হচ্ছে জটিলতা। সরকারের নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞ মহলে বছরের পর বছর ধরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও এ বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা পুঞ্জীভূত মামলার সংখ্যা ২ লাখ ৭ হাজার ৮৯৬টি। এর বিপরীতে দাবির পরিমাণ ২ লাখ ১৩ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। তবে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত নিষ্পত্তি করা মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬২৫টি। এর বিপরীতে প্রকৃত আদায় ১৯ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে অর্থঋণ আদালতে বর্তমানে আটকে আছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। গত বছরে এসব মামলা থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা।
সম্প্রতি জনতা ব্যাংকের এক গ্রাহকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ২০ বছর আগে মামলা করে আর খোঁজ নেয়নি ব্যাংক। বাদিপক্ষের অনাগ্রহের কারণে ২০ বছর পড়ে ছিল মামলাটি। শুধু জনতা ব্যাংকেই নয়, এরকম সমস্যা অন্যান্য ব্যাংকেও রয়েছে বলে জানা গেছে। ব্যাংকের আইনজীবীদের অনীহার কারণেও অর্থ আদায়ে বিলম্ব হয় বলে মত আদালতের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঋণ আদায়ের জন্য সাধারণত চার ধরনের আদালতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আদালতগুলো হলোÑঅর্থঋণ আদালত, দেউলিয়া আদালত, সার্টিফিকেট আদালত ও দেওয়ানি আদালত। ব্যাংকগুলো অর্থঋণ আদালতেই বেশিরভাগ মামলা করে। এ আদালতেই ব্যাংকের অধিকাংশ খেলাপি ঋণ আটকে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণত প্রতি ৬ মাস পর হালনাগাদ তথ্য দিয়ে মামলার বিবরণী তৈরি করে। সর্বশেষ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক তথ্য দিয়ে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিচারাধীন মামলায় এখন সরকারি ৯ ব্যাংকের দাবির পরিমাণ ৬২ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। বেসরকারি ৪০ ব্যাংকের ৭৬ হাজার ১৯ কোটি, বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৩ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ২ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা।
বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিচারাধীন মামলার দাবির পরিমাণ কম হলেও পুঞ্জীভূত মামলা ও দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ বেশি। সুতরাং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অর্থঋণ আদালতে বেশি মামলা করেছে এবং তাদের মোট দাবির পরিমাণও বেশি। এর কারণ হিসাবে ব্যাংকাররা বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগই ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে।
তারা মনে করেন, গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয়। ফলে তাদের ঋণ আদায়ের হার বেশি। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সেটা কম দেখা যায়। কারণ সরকারি ব্যাংকগুলোতে অনেক সময় ঋণ দেয়া-নেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়। এসব ঋণ এক সময় আদায় না হওয়ায় কুঋণে পরিণত হয়। আর কুঋণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক পর্যায়ে আদায় হয় না। আদালতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো তাই অর্থঋণ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে মামলা করে থাকে।
কিন্তু আদালত পর্যাপ্ত না থাকায় মামলার নিষ্পত্তি হয় ধীরে ধীরে। এভাবেই খেলাপি ঋণসংক্রান্ত মামলার পাহাড় জমতে থাকে। সরকারি ব্যাংকের মতো এখন কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকেও মামলার সংখ্যা বাড়ছে।
এর কারণ হিসেবে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বারবার ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেয়ায় যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও এখন নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও কুঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আর ঋণ আদায়ের জন্য শেষ পর্যন্ত আদালতে মামলা করতে হচ্ছে। এতে একদিকে ব্যাংকের মামলা পরিচালনায় ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সময়মতো মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ব্যাংকের টাকা আটকে যাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা।
এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, পর্যাপ্ত সংখ্যক আদালত ও বিচারক সংকটের কারণে মামলাগুলো দীর্ঘদিন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকে। আবার আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে নেন অনেক ঋণখেলাপি। এর ফলে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয় ব্যাংকের। পাশাপাশি নষ্ট হয় মূল্যবান সময়। তিনি বলেন, খেলাপিদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের আইনি কাঠামো অন্যান্য দেশের মতো শক্তিশালী নয়। যা আছে সেই আইনি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রভাবশালী শক্তি সক্রিয় বলে মনে করেন তিনি।
অর্থঋণ বিষয়ক বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন শেয়ার বিজকে বলেন, একটি নির্দিষ্ট সময় পর খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালত আইন অনুযায়ী আদালতে মামলা করে ব্যাংক। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ মামলা দায়ের করা না হলে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট অফিসারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে অর্থঋণ আদালত আইনে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার বাইরে যেসব অর্থঋণ আদালত আছে, সেখানে অর্থঋণ মামলার বাইরেও অন্যান্য মামলা পরিচালনা করে থাকেন অর্থঋণ আদালত। এতে অর্থঋণ মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। তাছাড়া ব্যাংকগুলোকেও মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও যতœশীল হওয়ার পরামর্শ এ আইনজ্ঞের। ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যাতে নিয়মিত মামলার খোঁজ রাখেন সে পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।