আধুনিক বাসযোগ্য পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে করণীয়

 

শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান : পরিবেশ হলো এমন একটি বিষয়, যা আমাদের পারিপার্শ্বিকতার স্থিতিশীলতা তৈরি করে এবং পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের ক্ষমতা প্রদান করে। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই তৈরি হয়ে আমাদের পরিবেশ; যা সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি অবগত। মাটি, পানি, বায়ু, গাছসহ প্রমুখ পারিপার্শ্বিক বিষয়ের সম্মিলনে একটি পরিবেশ সুশৃঙ্খল সুচারুভাবে গড়ে ওঠে। এসব বেঁচে থাকার রসদ জোগান দেয় মানুষের মধ্যে।

সবুজ নিরাকার দৃশ্যে মন উৎফুল্ল করতে গাছের জুড়ি নেই। সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামল এই দেশে সবুজের রোমাঞ্চ অনুভব করতে গাছ অত্যাবশকীয় একটি উপাদান। গাছের উপকারিতা ও গুণাগুণ অপরিসীম। গাছ একদিকে পরিবেশের সৌন্দর্য বজায় রেখে মানুষ এর প্রশান্তিকরের উপলব্ধি করে। আর বনজ ঔষধি হিসেবে বিভিন্ন গাছ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। প্রাচীনকাল বা অতীতে যখন চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেনি। তখন মানুষ বনজ, ঔষধি গাছের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিল। পরিবেশ এর সৌন্দর্য নির্ভর করে গাছের ওপর। গাছ যত বেশি লাগানো হবে, পরিবেশ হবে তত বেশি সমৃদ্ধ ও সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। এতে তাপমাত্রা স্থিতিশীল থাকবে। অতিরিক্ত গরম অনুভূত হবে না। ঝড়, তুফান, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, টর্নেডো থেকে রক্ষা করবে গাছগাছালি। বিকেলে স্নিগ্ধ সুবাতাস একঝলক প্রকৃতিকে অনুভব করতে গাছের হিমশীতল ছায়ায় আশ্রয় সারাদিনের বিবর্জিত ক্লান্তিবোধ অদ্ভুত প্রশান্তিতে মিইয়ে দেয়।

একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের জন্য অজীব ও জীব প্রতিটি উপাদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভৌতিক, রাসায়নিক ও জৈবিক কারণে এ উপাদানগুলোর মধ্যে যে কোনো একটির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলে সামগ্রিক পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং পরিবেশ দূষণ হয়। মানুষের অসচেতনতা এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনবোধের কারণে-অকারণেই পরিবেশ দূষণ হচ্ছে ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। পরিবেশে দূষণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যাচ্ছে। এতে পরিবেশ হারাচ্ছে তার নিজস্ব স্বকীয়তা ও সৌন্দর্য।

কিন্তু বর্তমানে  প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ বিরাজ করছে। এর ব্যতিক্রম নয় আমাদের দেশও। আমাদের দেশে পরিবেশের অবস্থা সুখকর নয়। কারণে-অকারণে  অপ্রয়োজনে গাছ কাটা হচ্ছে। বনভূমি নিধন করে উজাড় করে দেয়া হচ্ছে। ফলে সবকিছু বিরানভূমিতে রূপ নিচ্ছে। পরিবেশের সুরক্ষা ও মান উন্নয়নের অবনতি হচ্ছে। ফলে পরিবেশ তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারাচ্ছে। তাপমাত্রার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে অসহনীয় গরম ও তীব্র দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে পর্যাপ্ত গাছহীনতার জন্য। হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য স্কুল-কলেজ বন্ধও দেওয়া হয়। এসবের পাশাপাশি কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত দূষণ বিরূপ প্রভাব ফেলছে জীব বৈচিত্র্যে। হিসাব করে দেখা গেছে, যানবাহন চলাচলের ফলে বায়ুদূষণ হয় ৪২ শতাংশ, জ্বালানি থেকে বায়ুদূষণ ২১ শতাংশ, কয়লা কারখানা থেকে বায়ুদূষণ হয় ৫ শতাংশ এবং অন্যান্যভাবে বায়ুদূষণ হয় ১৮ শতাংশ। শস্যে ফসল ফলা গাছের সবুজের সমারোহ বহমান থাকলে এই পরিস্থিতি থেকে খানিকটা হলেও রেহাই পেত সাধারণ মানুষ। তাছাড়া একটি কথা আছে, একটি গাছ কাটা হলে তার পরিবর্তে দশটি গাছ লাগাতে হবে। প্রকৃতপক্ষে তাও হচ্ছে না।

এই তীব্র দাবদাহ সাধারণ মানুষের শারীরিক অবস্থার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। কারণ তীব্র তাপে শরীর ডিহাইড্রেটেড হয়ে পড়লে, সেটির প্রভাব শারীরিক এবং মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রকটভাবে পড়বে। লরিয়েট ইনস্টিটিউট ফর ব্রেন রিসার্চ অব তুলসা, ওকলার সভাপতি এবং বৈজ্ঞানিক পরিচালক ডা. মার্টিন পলাস বলেন, ‘আমাদের দেহ একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত মানসিক চাপ নিতে অভ্যস্ত। দাবদাহের সময় যখন শরীর তার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, তখন মানসিকভাবে অতিরিক্ত চাপ যোগ হয় এবং এর ফলে স্ট্রেস ও প্রদাহ আরও বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে যাদের আগে থেকেই কোনো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আছে, তাদের জন্য এ অতিরিক্ত তাপ-চাপ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

তাছাড়া মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে উৎপাদিত ক্ষতিকারক পদার্থ, যেমনÑগ্রিন হাউস গ্যাস, ইগজোস্ট গ্যাস, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, আর্সেনিকযুক্ত বর্জ্য, পারদ, ক্যাডমিয়াম, সিসা, বালাইনাশক, আগাছানাশক, ধোঁয়া, ধোঁয়াশা, ধূলিকণা, ময়লা-আবর্জনা ইত্যাদি মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করে। গ্রিন হাউস ইফেক্টের কারণে বায়ুমণ্ডলের তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গ্যাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড ৫০%, মিথেন ২০%, সিএফসি ১০%, নাইট্রাস অক্সাইড ১০% এবং অবশিষ্ট ১০% কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন পারঅক্সাইড ও কিছু অন্যান্য গ্যাস থাকে। গাছের লাগানোর বিষয়ে মানুষের উদাসীনতা পরিবেশ দূষণে হুমকির বার্তা দিয়ে রাখছে। সৌষ্ঠবপূর্ণ এই দেশে সবুজের রোমাঞ্চ অনুভব করতে গাছ বাড়ির আঙিনায় লাগাতে হবে। অন্যকে উৎসাহিত করতে হবে। অন্যত্রায় আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে আমাদের।

তাই ভবিষ্যৎ প্রজš§ ও গাছের উপকারিতা বৃদ্ধিতে এই তীব্র তাপদহন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি। জনসচেতনতায় ভিন্ন মাত্রা আনতে হবে। অপ্রয়োজনীয় গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পন্থা  অনুযায়ী পরিবেশ খাতে গবেষণা বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবেশ খাতকে আধুনিক চাহিদাসম্পন্ন ও গবেষণা নির্ভর করতে হবে। এতে পরিবেশ খাতে ভিন্নতা যুক্ত হবে। বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থায় পরিবেশ মান বজায় রাখতে হবে। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে হবে। কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যাবতীয় দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।

পরিবেশবান্ধব যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া তাপমাত্রাকে প্রাধান্য দিতে হবে। আঞ্চলিক পর্যায় অনুযায়ী গাছের বেড়ে ওঠা ও পরিচর্যাকে সুশৃঙ্খল করতে হবে; যা সাধারণ মানুষের জীবন নিরাপদ ও বৈচিত্র্যেময়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করবে।

শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০