এনামুল হক নাবিদ, আনোয়ারা (চট্টগ্রাম): চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় চলতি বছর ১০ মাসে (জানুয়ারি থেকে অক্টোবর) পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ১৮টি শিশুর। পানিতে ডুবে মারা যাওয়া এসব শিশুর বেশিরভাগের বয়স দুই থেকে আট বছরের মধ্যে। নানা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে এমন তথ্য ওঠে এসেছে।
সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব শিশু মৃত্যুর স্থান আর সময় ভিন্ন হলেও তাদের মৃত্যুর কারণ একটাই। পরিবারের অজান্তে খেলতে গিয়ে পুকুরে পড়ে যায়, না হয় বাড়ির পাশে কোনো জলাশয়ে। আর সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়। তাই প্রায় সব মৃত্যুর ক্ষেত্রে হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তারের মুখ থেকে শুনতে হয়, হাসপাতালে আনার আগেই তারা মারা গেছে।
সর্বশেষ গত ১৩ অক্টোবর বুধবার বিকাল ৫টায় উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডে ডোবার পানিতে ডুবে আফিয়া সুলতানা নামে তিন বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আফিয়া সুলতানা ওই গ্রামের কুলাল পাড়ার আবু সিদ্দিকের মেয়ে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মুসা তালুকদার জানান, বিকালের দিকে স্থানীয় প্রবাসী আবু সিদ্দিকের মেয়ে খেলতে গিয়ে ডোবার পানিতে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সন্তানকে দেখতে না পেয়ে খুঁজতে শুরু করেন মা। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে বাড়ির পাশের ডোবা থেকে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে তিনি মৃত ঘোষণা করেন।
ফেব্রুয়ারিতে বরুমছড়া ইউনিয়নে দুপুর দেড়টার দিকে বাড়ির আঙিনায় খেলতে গিয়ে পুকুরে ডুবে আযান (২) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়। ১ মার্চ উপজেলার ১০নং হাইলধর ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে একসঙ্গে পুকুরে পড়ে রিতু আকতার (৮) ও হামদান (২) নামের দুই ভাইবোনের মৃত্যু হয়।
৪ এপ্রিল একই ইউনিয়নের পীরখাইন গ্রামের ফারজানা মাহমুদ ওহী (৭) নামের দ্বিতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়। ২৫ মে উপজেলার ৮নং চাতুরী ইউনিয়নের রুদুরা গ্রামের মো. হেলাল (৪) নামে এক শিশু পরিবারের অজান্তে পুকুরে পড়ে মৃত্যু হয়।
জুনে পানিতে ডুবে তিন শিশুর মৃত্যু হয়। যাদের মধ্যে ১১ জুন ৮নং চাতরী ইউনিয়নের কৈণপুরা গ্রামের মহাজন পাড়া এলাকায় অতুল মহাজন (৫), ১২ জুন ১০নং হাইলধর ইউনিয়নের পীরখাইন পশ্চিম পাড়ার হামেদ হাসান (২) ও ১৪ জুন ৬নং বারখাইন ইউনিয়নের তৈলারদ্বীপ গ্রামের মো. তাহমিদ (২)।
এ ১০ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে জুলাইয়ে। এ মাসে একনাগাড়ে চারটি শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়ে সারা বছরের মধ্যে বেশি শিশু মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে। ১ জুলাই ১০ নং হাইলধর ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামের সোহান (২), ১৩ জুলাই ৯নং পরৈকোড়া ইউনিয়নের বাথুয়া পাড়া গ্রামের প্রান্ত সর্দ্দার (৬) এবং ৩০ জুলাই উপজেলার ১১ জুইদন্ডি ইউনিয়নের তাসনুভা তাবাসসুম তানিশা (৫) আর তার ফুফাতো বোন মোছাম্মৎ তায়্যিবাহ (৩) নামের দুই মামাতো ফুফাতো বোনের একসঙ্গে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়।
১ আগস্ট উপজেলার ৩নং রায়পুর ইউনিয়নের চুন্নাপাড়া গ্রামে মাছ ধরতে গিয়ে বিলের পানিতে ডুবে হাবিবা আক্তার (৯) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ৪ আগস্ট ৩নং রায়পুর ইউনিয়নের পরুয়া পাড়া এলাকার তামিম (২) নামের এক শিশুর পুকুরে ডুবে মৃত্যু হয়। ২৫ আগস্ট বুধবার ১০নং হাইলধর ইউনিয়নের তেকোটা গ্রামে মুরসালিন (৫) নামের এক শিশুর পুকুরের পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টার দিকে ৩নং রায়পুর ইউনিয়নের দক্ষিণ পরুয়াপাড়া গ্রামে পুকুরে ডুবে মো. ফোরকান নামের (৮) বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নিহত ফোরকান স্থানীয় বদিউল আলমের ছেলে।
৯ অক্টোবর বেলা ১১টায় জুঁইদণ্ডী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ছিদ্দিকের বাড়িতে খেলতে গিয়ে পুকুরে ডুবে রিয়া মনি নামে ছয় বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শিশুটি স্থানীয়
মো. আনোয়ারুল ইসলামের মেয়ে। তাছাড়া অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে হাইলধর গ্রামে পানিতে ডুবে আরও দুই শিশুর মৃত্যু হয়। তবে তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এসব মৃত্যুর ঘটনার বেশিরভাগ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টার মধ্যে। কারণ এ সময় শিশুদের মায়েরাসহ পরিবারের লোকজন রান্নাসহ গৃহস্থালির নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। আর বাবারা থাকেন ঘরের বাইরে।
চলতি বছর ২৫ জুলাই যে কেউ পানিতে ডুবে যেতে পারি, সবাই মিলে প্রতিরোধ করি- এ সেøাগান সামনে রেখে বিশ্বে প্রথমবারের মতো পালিত হয় বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস। পানিতে ডুবে মৃত্যু একটি বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর দুই লাখ ৩৬ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে বেশি মৃত্যু ঘটে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে।
পানিতে ডুবে দ্রুত মৃত্যু হওয়ার বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু জাহি মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন জানান, পুকুরে ডুবে শিশু মারা যাওয়া কারণ হচ্ছে শিশুদের সাঁতার না জানা, তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান না থাকা ও সচেতনতার অভাব। অনেক পুকুরে ডোবা শিশু রয়েছে যাদের তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও যথাসময়ে হাসপাতালে আনার কারণে বাঁচানো গেছে।
উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা রাবেয়া চৌধুরীর সঙ্গে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণের বিষয় নিয়ে কথা হলে তিনি জানান, আসলে পুকুরে ডুবে শিশু মৃত্যুর বিষয়টি পরিবারের অসচেতনতার কারণে হয়ে থাকে। তাই বিষয়টি নিয়ে মাঠ দিবসে আমরা আলোচনায় রাখব যাতে সবার মাঝে বিশেষ করে মায়েদের মাঝে সচেতনতা বাড়ে।