সুমাইয়া আকতার: প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমার থেকে ৫৭টি গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃসীমান্ত নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জলতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই এ নদীগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই আন্তঃসীমান্ত নদীতে দীর্ঘদিন ধরে অধিকারহারা আমাদের বাংলাদেশ। নদীগুলোর ওপর ভারতের একতরফা আধিপত্য প্রসারকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ ও বাংলাদেশের উজানে ভারতনির্মিত ড্যাম ও ব্যারাজের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ভারতের ওপর বাংলাদেশের মানুষের আক্ষেপ অনেক দিনের। চলতি বছর আগস্টের বন্যায় প্লাবিত হওয়া বানভাসি মানুষ বন্যার কারণ হিসেবে দায়ী করছে প্রতিবেশী দেশ ভারতকে। তথাকথিত এই আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো সংরক্ষণ ও পানির ন্যায্য হিস্যার অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় নেই কোনো নথিপত্র ও স্বীকৃতি। ফলে পানির প্রবাহ একাই নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। তাই বাংলাদেশের শুকনা মৌসুমে পর্যাপ্ত পানির অভাবে কৃষি খাতে যথেষ্ট ফলন হচ্ছে না, পলি সৃষ্টি হয়ে চর জাগছে; পলির অংশবিশেষ নদীর তলদেশকে ভরাট করে তুলছে, যা বন্যা সংঘটনের জন্য অনেকাংশে দায়ী। বর্ষা মৌসুমে কোনোরূপ সতর্কবার্তা ছাড়াই বাঁধ খুলে দেয়ায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
ভারত থেকে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী, ফুলবাড়ী, রৌমারী ও রাজারহাটের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে ১৯টি আন্তঃসীমান্ত নদী। তবে ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন ৫৪ নদীর তালিকায় উত্তরাঞ্চলে শুধু ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার ও জিঞ্জিরামের নাম আছে। তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ১৪ নদী। শুধু কুড়িগ্রাম নয়, সারাদেশে এমন ৬৯টি নদী বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) তালিকায় নেই। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রবাহিত তিনটি আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্যে মিয়ানমারের দিক থেকে শুধু নাফ নদ স্বীকৃত। অন্য দুটি নদী সম্পর্কে দেশটির কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দাপ্তরিকভাবে স্বীকৃত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর বাইরেও এ পর্যন্ত আরও অন্তত ৬৯ নদী চিহ্নিত করেছে রিভারাইন পিপল, যেগুলো ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছে, কিংবা বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢুকেছে। এ ব্যাপারে রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, দেশে স্বীকৃত আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা ৫৭ বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। শুধু রংপুর বিভাগে স্বীকৃত আন্তঃসীমান্ত নদী আছে ১৮টি। অনেক বড় নদীও এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। যেমন, কুড়িগ্রামের গঙ্গাধর বড় নদী হওয়ার পরও তালিকার বাইরে। নদী ছোট হোক, বড় হোক সব আন্তঃসীমান্ত নদীর দ্বিদেশীয় স্বীকৃতি থাকা জরুরি। নদীর প্রশ্নে উজানের দেশ ভারতের মনোভাব কখনোই সৌহার্দ্যপূর্ণ নয়। ফলে তারা চাইবে নদীগুলোর স্বীকৃতি না হোক। এতে এসব নদীর পানি তারা প্রশ্নহীনভাবে প্রত্যাহার করার সুযোগ পেতে পারে। ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের তাগিদ দিয়ে হলেও আন্তঃসীমান্ত সব নদীর স্বীকৃতি নেয়া জরুরি। তিনি বলেন, অর্ধশতাধিক বছরের বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আমরা আন্তঃসীমান্ত নদীর প্রকৃত তালিকাই প্রস্তুত করতে পারিনি, এটা লজ্জার।
এছাড়া উপনদীগুলোর ওপর ভারতের একাধিক ড্যাম ও ব্যারাজ। ফলে প্রবল বৃষ্টিতে নদীর উজানে পানির চাপ বাড়ায় ড্যাম ও ব্যারাজ খুলে দিলে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল ভেসে যায়। কিন্তু বাঁধ খুলে দেয়ার বিষয়টি জানে না ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, উজানের দেশ তাদের প্রয়োজনে বাঁধ খোলার আগে বিষয়টি ভাটির দেশকে আগেই জানানো উচিত, যাতে ভাটির লোকজন নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে। অভিন্ন নদীর উজানে যদি এই বাঁধগুলো না থাকত, তাহলে পানির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সচল থাকত; হুট করে ভয়াবহ বন্যা সৃষ্টি হতো না এবং নদীগুলো ন্যায্যতা হারাত না।
সিকিমের পর্বতশৃঙ্গ থেকে উৎপন্ন ভারত-বাংলাদেশের লাইফলাইন বলে খ্যাত তিস্তা নদীর ওপর ১০টিরও বেশি ব্যারাজ ও জলাধার নির্মাণ করেছে ভারত। ফলে তিস্তায় পানিঘাটতির কারণে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ টন বোরো ধান উৎপন্ন হওয়া থেকে বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। এছাড়া তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ইতিবাচক আশ্বাস দিলেও কথা রাখেননি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার নিজস্ব রাজনীতির স্বার্থে গঙ্গা পানিচুক্তি ও তিস্তার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কখনও মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন, আবার কখনও বাংলাদেশপ্রীতির কথা বলছেন; কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। ২০১১ সালে আরেকটি চুক্তির কথা হয়েছিল, যার অধীনে বাংলাদেশ তিস্তার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ জল এবং ভারত ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ জল পাবে বলে স্থির করা হয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে নদীর প্রবাহ কমার কথায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে এই চুক্তি আর স্বাক্ষর করা হয়নি। সেই থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিস্তা নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে কেন্দ্র-রাজ্যের রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনীহার কারণেই তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না বলে মন্তব্য করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের নদীগুলোর আন্তঃসংযোগ ও শান্তিচুক্তি অনুযায়ী যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও যথাযথভাবে পানি বণ্টনে ব্যর্থ এ প্রতিষ্ঠানটি। পক্ষান্তরে স্বাধীনতার পর শুধু পানিবণ্টন চুক্তি হয়েছিল গঙ্গা নদী নিয়ে দুটি দেশের ভেতরে। সাধারণ নদীগুলোর সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে দুটি দেশই সর্বাধিক সুযোগসুবিধা নিতে পারে, সে ব্যাপারে দুটি দেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার বিষয়টি উল্লেখিত হলেও বাস্তবিকক্ষেত্রে দেখা যায়নি এত বছরে।
বাংলাদেশ যদি তার পানির ন্যায্য হিস্যা না পায়, তাহলে ভারতকে ট্রানজিটসহ যেসব সুবিধা দেয়া হচ্ছে, সেগুলো পুনর্বিবেচনা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অভিন্ন নদী থেকে পানিবণ্টন ও পানির নায্য হিস্যার ক্ষেত্রে ভারতের বাহানা বাংলাদেশকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এছাড়া অভিন্ন নদীতে বাঁধ দেয়ার আগে নেই কোনো চুক্তি বা সমঝোতা। এ বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দ রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির অধিকার ও হিস্যা আদায়ে ভারতের সঙ্গে খুব দ্রুতই আলোচনায় বসবেন। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক নদীর পানির ভাগাভাগির বিষয়টি অত্যন্ত জটিল হলেও জরুরি তথ্য ভাগাভাগি রাজনীতি নয়।
তাই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আবার গঠন করে দেশের অভ্যন্তরে ও প্রতিবেশী দেশের সব আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ওপর পর্যবেক্ষণ ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রয়োজনে বহুপক্ষীয় ব্যবস্থায় উদ্যোগ নিতে হবে। দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তি করে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করাসহ জাতিসংঘের ‘নদী কনভেনশন, ১৯৯৭’ সনদে বাংলাদেশের অনুস্বাক্ষর ও যৌথ নদী কমিশনকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দিয়ে সক্রিয় করতে হবে। এছাড়া বর্তমান বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকার কারণে আমাদের দেশ আন্তর্জাতিক নদীগুলোর স্বীকৃতি পায়নি। সে বিষয়টি এখন শীর্ষ আলোচনায় রাখতে হবে। পদ্মা সেতুকে অর্থবহ করে তুলতে হলে এবং পদ্মার স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখতে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের বিকল্প নেই। এছাড়া কৃষি খাতে টেকসই উন্নয়নে অভিন্ন নদী এবং সাধারণ নদীর পানির প্রবাহকে অব্যাহত রাখতে আন্তঃসীমান্ত নদীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।