Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 9:37 am

আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরার সক্ষমতা নেই দেশীয় প্রতিষ্ঠানের

সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৫২ সালে সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। একসময় দপ্তরটি শিল্প বিভাগের অধীন ছিল। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এলেও প্রয়োজনীয় জনবল ও নৌযানের অভাবে ধুঁকছে সরকারি এ সংস্থাটি। দপ্তরটির নানা সমস্যা নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ছাপা হচ্ছে শেষ পর্ব

সাইদ সবুজ, চট্টগ্রাম: ভারত মহাসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরার জন্য ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছিল সরকার। চলতি বছর থেকে টুনাজাতীয় মাছ আহরণের কথা ছিল এসব প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের গভীরে এবং ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় কোনো ধরনের জরিপ না থাকায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছেন না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বঙ্গোপসাগরের ৫০০ মিটার গভীরতার পর থেকে ভারত মহাসাগরের উš§ুক্ত এলাকায় লং লাইনার ও পার্স সেইনিং প্রযুক্তিতে মাছ ধরার জন্য ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছিল। এর আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে তিনটি লং লাইনার জাহাজকে অনুমতি দিয়েছিল। এসব প্রতিষ্ঠান বিশ্ববাজারে অন্যতম আকর্ষণীয় সামুদ্রিক খাদ্য মূল্যবান সেইলফিশ, টুনাজাতীয় ও ব্লুমার্লিন প্রজাতির মাছ আহরণ করার কথা। কিন্তু অনুমতিপ্রাপ্ত ১৬টি জাহাজের মধ্যে কেউই এখনও কার্যক্রম শুরু করেনি।

জানা যায়, লং লাইনার ও পার্স সেইনিং প্রযুক্তিতে মাছ ধরার জন্য বৃহৎ অঙ্কের বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চলের ২০০ মিটার গভীরতার ঊর্ধ্বে কোনোরূপ বিস্তৃত জরিপ নেই। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জলসীমায়ও জরিপ করতে পারেনি বাংলাদেশ। ফলে ওইসব অঞ্চলে কী পরিমাণ মাছ মজুদ আছে তার সঠিক হিসাব নেই মৎস্য দপ্তরের কাছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে টুনার উচ্চমূল্য হওয়ার পরও  লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

এ বিষয়ে লং লাইনারের অনুমতি পাওয়া কর্ণফুলী লিমিটেড মহাব্যবস্থাপক শাহ আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা গভীর সমুদ্রে লং লাইনার দিয়ে টুনাজাতীয় মাছ ধরার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি জাহাজে অনুমতি পেয়েছি। তবে আমরা এককভাবে সক্ষম না হওয়ায় একটি চায়নিজ কোম্পানির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং সেটা মন্ত্রণালয়ও অনুমোদন দিয়েছিল। তারপর ওই কোম্পানি নিজেদের মতো করে কিছুদিন সমীক্ষা চালিয়েছিল গভীর সমুদ্রে। কিন্তু আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় চায়নিজ কোম্পানিটি ফিরে যায়। এদিকে মন্ত্রণালয়ের দেওয়া মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই মেয়াদকাল বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি।’

মৎস্য অধিদপ্তরের মেরিন ফিশারিজ সার্ভে ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জরিপ ব্যবস্থাপনার প্রধান মো. শরিফ উদ্দীন বলেন, ‘গভীর সমুদ্রে ২০০ মিটার গভীরে আমাদের জরিপ নেই। তাই জরিপের জন্য ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি পাইলট প্রকল্পের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটির অনুমোদন পেলে ৫০০ মিটার গভীর পর্যন্ত জরিপ করা হবে। এ বিষয়ে সরকার খুব আন্তরিক। তবে আন্তর্জাতিক জলসীমায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলো টুনাজাতীয় মাছ আহরণ করছে।’

বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চলের সর্বোচ্চ ২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত এলাকায় মাছ ধরতে পারে বাংলাদেশি জাহাজ, যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক নৌযানগুলো; যা দেশের সমুদ্রসীমার এক-তৃতীয়াংশ মাত্র। অথচ এর বাইরেও দুই-তৃতীয়াংশ একচ্ছত্র  অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়াও আছে ভারত মহাসাগরের আন্তর্জাতিক উম্মুমক্ত এলাকা, যেখানে রয়েছে টুনাজাতীয় মাছের আনাগোনা। কিন্তু গভীর সমুদ্রে টুনাজাতীয় মাছ ধরতে হলে বিশেষ জাহাজে করে বড়শিজাতীয় প্রযুক্তি লং লাইনার এবং ঘেরাজালের প্রযুক্তি পার্স সেইনিংয়ের মাধ্যমে ধরতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের সক্ষমতা না থাকায় ব্লু ইকোনমির পুরোপুরি সুফল পাচ্ছে না বাংলাদেশ।

জানা গেছে, ভারত মহাসাগরের উম্মুক্ত এলাকায় বড় আকারের টুনা মাছের বিভিন্ন প্রজাতি, বিশেষ করে ইয়েলো ফিন, স্কিপ জ্যাকের আনাগোনা রয়েছে এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলো মাছ আহরণ করছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে অতি উচ্চমূল্য হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী টুনা মাছের আহরণ নিয়ন্ত্রণ এবং এর মজুদ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে আসছে জাতিসংঘ।

সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ভারত মহাসাগরে মাছ আহরণের জন্য যেসব  কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে লং লাইনারের অনুমতি পেয়েছে, ওরিয়েন্ট ট্রেডিং করপোরেশন, নৌ কল্যাণ শিপিং লাইন লিমিডেট ও নৌ কল্যাণ ফাউন্ডেশন ট্রেডিং করপোরেশন (একই সঙ্গে তার দুটি পার্সে সেইনারের অনুমতি পেয়েছে), আমিন এন্টারপ্রাইজ, ব্যানসেন অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড, কন্টিনেন্টাল মেরিন ফিশারিজ লিমিটেড, মিলিনিয়াম ফিশারিজ, ডায়মন্ড ফিশারিজ, কর্ণফুলী লিমিটেড। পার্সে সেইনারের অনুমতি পেয়েছেÑআল রাফী ট্রাভেলস ট্রেড, সিয়াম এভিয়েশন, গাজীপুর এস্টাবিলিম মেন্ট অ্যান্ড কন্সট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড, গ্লাক্সি ট্রেডিং করপোরেশন ও কনসেপ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড।

সামুদ্রিক সৎস্য দপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক মো. লতিফুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ২০০৭ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়কালে ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্ট্রিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমি কোপারেশন’ (বিএইএমটিইসি) ভুক্ত দেশ কর্তৃক যৌথভাবে পরিচালিত জরিপে বঙ্গোপসাগরের গভীরে ও ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় পেলাজিক লং লাইনার দ্বারা বাণিজ্যিক সম্ভাবনাময় মূল্যবান বড় আকারের অভিপ্রয়ানশীল পেলাজিক মৎস্যের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তারপর একাধিক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের আগ্রহ দেখালে মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময় ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে লং লাইনার ও পার্সে সেইনারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে ট্রলার ও যান্ত্রিক মৎস্য নৌযান কর্তৃক আহরিত মাছের মধ্যে নন-টার্গেটেড মাছ হিসেবে পাঁচ থেকে ছয় হাজার মেট্রিক টন বিভিন্ন প্রজাতির টুনা ও মেকারেল আহরিত হচ্ছে।