আন্তর্জাতিক দাঁত চক্রের হাতেই শেরপুরে হাতি হত্যা!

রফিক মজিদ, শেরপুর: আন্তর্জাতিক হাতির দাঁত চোর বা দাঁত কারবারি চক্রের হাতে শেরপুর সীমান্তে হাতি হত্যা হচ্ছে বলে চাঞ্চল্যকর খবর পাওয়া গেছে। সর্বশেষ গত ৩ জুন শুক্রবার ঝিনাইগাতি সীমান্তে একটি মৃত হাতি উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। সেটিরও দাঁত খোয়া যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও বন বিভাগ সে তথ্য উড়িয়ে দিয়েছে।

সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শেরপুর জেলার প্রায় ৪০ কিলোমিটার সীমান্তের গারো পাহাড়ের ওপারেই ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্য। সেখানে রয়েছে আন্তর্জাতিক হাতির দাঁত কারবারি বা চোরদের আস্তানা। বিভিন্ন সময় ভারতের আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে এ হাতির দাঁত কারবারিদের স্থানীয় পুলিশসহ প্রদেশিক বিভিন্ন বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার খবর ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

গত প্রায় এক যুগ ধরে শেরপুর সীমান্তে হাতির অস্থায়ী আবাসস্থল গড়ে ওঠায় ওই চক্রটি বাংলাদেশের দিকে নজর দিয়েছে। এরই মধ্যে বিগত পাঁচ বছরে সীমান্তে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাতি হত্যা ও মারা পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দাঁতওয়ালা বা পুরুষ হাতিও ছিল বেশ কয়েকটি। এর আগে মৃত হাতি মাটি চাপা দেয়ার কয়েক দিন পর ওই মৃত হাতির কবর খুঁড়ে হাতির দাঁত এবং মূল্যবান অঙ্গ তুলে বা কেটে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে।

শেরপুর বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শেরপুরের ঝিনাইগাতি উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী গাড়ো পাহাড় থেকে একটি পুরুষ বন্যহাতির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের গজনী বিটের ১১০১নং পিলারের বেরবেড়ী নামক স্থান থেকে মৃত হাতিটি উদ্ধার করা হয় এবং পরে ওই স্থানেই মাটি চাপা দেয়া হয় বলে সূত্র জানায়।

স্থানীয়রা জানান, অনেক দিন থেকেই হাতির অবস্থান এই অঞ্চলে। সীমান্তের ঝিনাইগাতি, শ্রীবর্দী ও নালিতাবাড়ীতে প্রায়ই বিভিন্নভাবে হত্যা করা হচ্ছে বন্য হাতি। শুক্রবারও একটি হাতির মৃতদেহ পাওয়া গেছে ভারত সীমান্তঘেঁষা এলাকায়। হাতিটিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে তারা জানান। হাতির মেরুদণ্ডের হাড়ের বাঁ পাশে বর্ষা দিয়ে ঘা মারার বড় ক্ষত রয়েছে। হাতিটির বয়স অনুমান ৫০ থেকে ৬০ বছর হবে। দাঁতওয়ালা এই হাতিটিকে আমরা জঙ্গলে আগেও দেখেছি। হাতিটি মারা পড়ার পর কে বা কারা দাঁত তুলে নিয়ে গেছে।

মৃত হাতির সন্ধানদাতা স্থানীয় শুক্কুর আলী জানায়, চার-পাঁচ দিন আগে গেনেন নামে স্থানীয় এক গারো মৃত হাতিটি দেখতে পান বলে আমি শুনেছি, কিন্তু তিনি বন বিভাগকে বলতে নিষেধ করেন গ্রামের অন্যান্য গারোকে। আমি বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘাস খাওয়াতে গরু নিয়ে যাই জঙ্গলে। কাঁটাতারের বেড়ার কাছে মৃত হাতিটি পড়ে থাকতে দেখি এবং কাছে যেতেই প্রচণ্ড দুর্গন্ধ পাই। পরে বন বিভাগের পাহারাদারকে হাতির মুত্যুর খবর জানাই। হাতির মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানা যায়, বড় গজনীর মান্নাট গারো ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ভাতুয়া বেলাবড় গ্রামে বিয়ে করেছিলেন। সেখানে তার এক শ্যালক আছেন, নাম শালভারা। তিনি ও তার সঙ্গীরা হাতিটি হত্যা করে থাকতে পারেন বলে তার ধারণা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গারো অধিবাসী জানান, শালভারা, নুকুল ও তাদের দুই সঙ্গী মেঘালয়ের ভাতুয়া বেলাভর গ্রামে বসবাস করেন। এই হাতিটি তারাই মেরে ফেলতে পারে। তাদের চারজনের কাছে হাতি হত্যায় ব্যবহƒত বিশেষভাবে বানানো ফালা (ধারালো সরু অস্ত্র) দেখেছি। তারা আগেও দাঁতের জন্য হাতি হত্যা করেছেন এই এলাকায়। প্রথমে তারা হাতির গতিবিধি লক্ষ করে গাছের উঠে বসে থাকেন। পরে হাতি গাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় ওপর থেকে ফালা (সরু ও ধারালো অস্ত্র) ছুড়ে মেরে দেহের ওপর বিদ্ধ করেন। পরে তারা হাতির পিছু নেন। হাতি মাটিতে পড়ে গেলে এবং মারা যাওয়ার পর তারা বিশেষ কায়দায় মুখের কাছের মাংস কেটে দাঁত খুলে নিয়ে যান। তাদের ফালা দেখে হাতিও ভয় পায়। ওই মৃত হাতিটির পড়ে থাকার স্থান আর তাদের বাড়ি প্রায় একই জায়গায়, মাঝখানে শুধু তারকাঁটার বেড়া।

বনের এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের জনৈক সদস্য নাম না বলার শর্তে জানান, আমরা এ পর্যন্ত কয়েকটি হাতি মাটিচাপা দিয়েছি। তবে এ হাতিটির বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছর হবে। হাতির পিঠে বড় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মনে হচ্ছে, এই হাতিটিকে হত্যা করা হয়েছে।

রাংটিয়া রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জার মকরুল ইসলাম জানায়, আমি হাতি মুত্যুর খবর পাই বৃহস্পতিবার বিকালে। সম্ভবত আরও দু-তিন দিন আগে হাতিটি মারা পড়ে। তবে হাতিটির দাঁত ছিল না এবং বয়স ১৫ থেকে ১৬ বছর হতে পারে। প্রাণিসম্পদ বিভাগ নমুনা নিয়েছে, রিপোর্ট পেলে হাতির মুত্যুর মূল কারণ বলা যাবে। আপাতত সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। এছাড়া তিনি আন্তার্জাতিক দাঁত কারবারির বিষয়ে জানান, আন্তর্জাতিক চক্রের বিষয়ে আমার জানা নেই, তবে একটি চক্র হাতি হত্যা বা হাতির ক্ষতিসাধণ করতে আমাদের এই শেরপুর জেলার সীমান্তে ঘোরাফেরা করছে, সে তথ্য আমার কাছে আছে এবং এ বিষয়ে আমি ও আমার অন্য বন কর্মকর্তারা সজাগ রয়েছি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০