আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে অন্যতম হাতিয়ার ইন্টারনেট বন্ধ!

নিজস্ব প্রতিবেদক: বৈশ্বিক ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থা থেকে পাঁচ দিনের বেশি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল বাংলাদেশ। ১৮ জুলাই দুপুর ১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেয়া হয় মোবাইল ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এ সেবা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বৈশ্বিক ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ক্লাউড ফেয়ার।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ডাকা কমপ্লিট শাটডাউনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে প্রথমে দুপুর ১টা থেকে বেলা ৩টার মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। ওইদিন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, পরিস্থিতি বুঝে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে।

ওইদিন বিকাল থেকে বিভিন্ন স্থানে ব্রডব্র্যান্ড ইন্টারনেটের গতিও কমতে শুরু করে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে সারাদেশের ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক গতকাল বলেছেন, সরকারের নির্দেশে নয়, ১৮ জুলাই নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে গেছে দেশের ইন্টারনেট সেবা। যদিও এর আগে তিনি আন্দোলনকারীদের অগ্নিকাণ্ডের জন্য মহাখালীতে থাকা খাজা টাওয়ারের ডেটা সেন্টার পুড়ে যাওয়ায় ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে বলে দাবি করেন।


এদিকে অগ্নিকাণ্ডের জন্য খাজা টাওয়ারের কোনো ক্ষতি হয়নি বলে এরই মধ্যে দাবি করেছে ইন্টারনেট সেবাদানকারী বিভিন্ন কোম্পানি তথা আইএসপি। এর আগে গত বছর অক্টোবর ও ডিসেম্বরে খাজা টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ইন্টারনেট সেবা প্রদান সাময়িক সমস্যা ও ধীরগতির সম্মুখীন হলেও এবার কোনো ক্ষতি ছাড়াই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

যদিও দেশে ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। বিভিন্ন সময় আন্দোলন দমন বা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট সেবা বিশেষত মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়। এছাড়া সাময়িকভাবে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও বন্ধ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ২০২৩ সালে বিরোধী দলের আন্দোলন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদে আন্দোলন ও ২০১৮ সালের আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন দমনেও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল উল্লেখযোগ্য। নিউইয়র্কভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান অ্যাকসেস নাউ গত মে মাসে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা বন্ধ তথা ইন্টারনেট শাটডাউন নিয়ে একটি ডেটাবেজ প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে তিনবার বন্ধ করা হয় ইন্টারনেট সেবা। ওই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১তম। আর ২০২২ সালে তা ছিল পঞ্চম। সে বছর দেশে ছয়বার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হয়। এছাড়া ২০২১ সালে দু’বার ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়।

অ্যাকসেস নাউয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ৭ ডিসেম্বর বিএনপির ডাকা অবরোধ কর্মসূচির সময় নয়াপল্টন, কাকরাইল ও আশপাশের এলাকায় ইন্টারনেট সেবা বিশেষত মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ বা গতি কমিয়ে ২জি করে দেয়া হয়। এর আগে বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে ২৮ অক্টোবর ও ২৮ জুলাই ওইসব এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ বা ২জি করে দেয়া হয়। ২০২২ সালে ১৯ এপ্রিল ঢাকা কলেজের ছাত্র ও নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের মাঝে সংঘর্ষের সময় ওই এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়। সে বছর ২২ অক্টোবর খুলনায়, ১১ মে বরিশাল ও ১১ ডিসেম্বর ফরিদপুরে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ বা ধীরগতি করে দেয়া হয়। তবে এগুলোর সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া বিএনপির আন্দোলনের কারণে ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায় ও ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ বা ধীরগতি করে দেয়া হয়।

এদিকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জš§শতবর্ষ উৎযাপনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় এলে তা বন্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ ও আন্দোলন হয়। সে আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলায় অনেকে প্রাণ হারান। ওই আন্দোলন প্রতিহত করতে দেশব্যাপী মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এছাড়া ওই বছর অক্টোবরে দুর্গাপূজার সময় কোরআনকে অবমাননার প্রতিবাদে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হলে তা নিয়ন্ত্রণে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়।
অ্যাকসেস নাউয়ের ডেটাবেজে দেখা যায়, ২০২০ সালে একবার ও ২০১৯ সালে দু’বার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উত্তেজনা দেখা দিলে তা দমনে আশপাশের এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। এছাড়া ২০১৯ সালে ৩১ ডিসেম্বর ভারতের সীমান্তঘেঁষা কয়েকটি জেলায় মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হয়েছিল।

এর আগে ২০১৮ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরিক্ষার প্রশ্নফাঁস প্রতিরোধে মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ ধীরগতির করে দেয়া হয়। তবে ওই বছর ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে ৮ এপ্রিল ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট ধীরগতি বা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ওই বছর ২৮ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দেশব্যাপী মোবাইল ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়।
এর বাইরে ২০১৮ সালে ১১ নভেম্বর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সাজা ঘোষণার দিন মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালে ইন্টারনেট বন্ধের কোনো ঘটনা না ঘটলেও ২০১৬ সালে ১ আগস্ট ভূগর্ভস্থ তার কাটা পড়ায় ইন্টারনেট বন্ধ ছিল কিছু সময়।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জš§দিন উপলক্ষে রাজধানীতে ‘শান্তির জন্য বৃক্ষ’ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গতকাল জুনাইদ আহ?মেদ বলেন, সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেনি। মহাখালীতে তিনটি ডেটা সেন্টারে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের (আইএসপি) ৭০ শতাংশ সার্ভার থাকে। দেশের ৩৪টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ের (আইআইজির) মধ্যে ১৮টির ডেটা এই তিনটি ডেটা সেন্টারে হোস্ট করা। দুই দিন পর তারা জানতে পেরেছেন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের কাঁচপুরে সাবমেরিনের কিছু কেব?ল ওপরের দিকে ছিল, সেগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

যদিও এর আগে ১৭ জুলাই মধ্যরাত থেকে ফোর-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ করায় দেশের মোবাইল ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ হয়ে যায়। ব্রডব্যান্ড সংযোগ ২৩ জুলাই চালু হলেও মোবাইল ইন্টারনেট এখনও বন্ধ। এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আজ রোববার সকালে মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে বৈঠক হবে। আলোচনা সাপেক্ষে রোববার-সোমবারের মধ্যে ফোর-জি উš§ুক্ত করে দেয়া হবে।
অন্যদিকে গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার সরকার খাজা টাওয়ারের ডেটা সেন্টারের ওপর চাপাচ্ছে। এর আগে মহাখালীর খাজা টাওয়ারে অবস্থিত ডেটা সেন্টার পরিদর্শন করেন তিনি।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি, বিটিআরসি এবং খাতসংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ইন্টারনেটের নিরাপত্তা, গুজব প্রতিরোধে এ ব্যর্থতার দায় মহাখালীর খাজা টাওয়ারের ডেটা সেন্টারের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আমরা গত দু’দিন আগে দেশের স্বনামধন্য গণমাধ্যমে জানতে পারলাম খাজা টাওয়ারের ডেটা সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। অথচ আইএসপি, এবি এবং বিটিআরসি ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বারবার ইন্টারনেট বন্ধের দায় চাপিয়েছেন ডেটা সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে। আজ আমরা ভবন পরিদর্শন করে এবং ভবনের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি এখানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০