আল আমিন ইসলাম নাসিম: অতি সম্প্রতি আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও তার সাবেক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর সঙ্গে হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ সময় তিনি আফগানদের তাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিজেদেরই নেয়ার আহ্বান জানান। আর এ নিয়ে আফগানিস্তানসহ পুরো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ও বিশ্বমোড়লদের মনে নয়া প্রশ্নের উত্থান হয়েছে। আর তা হলো আফগান অধিবাসীরা বা নীতিনির্ধারকরা নিজেরাই কি পারবে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে, নাকি আবার সংঘাতে জড়াবে? অথবা নিজেরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে সক্ষম হলেই বা ‘মার্কিন-আফগান’ দু’দশকের সংঘাতের পর সমগ্র আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে?
উপরন্তু আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ জানতে হলে এর আদি কিচ্ছা জানা অতীব জরুরি। আর এর কিচ্ছা শুরু হয় ২০০১ সাল থেকে। মূলত ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলা চালানো হয়। এ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানে যায় যুক্তরাষ্ট্র। তদুপরি যুক্তরাষ্ট্রে যে সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হয়ে থাকে, ইতিহাসে তা ‘নাইন-ইলেভেন’ নামে সর্বাধিক পরিচিত। মূলত আল-কায়েদা নামক আন্তর্জাতিক একটি জঙ্গি সংগঠন যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনে হামলা চালায়। পক্ষান্তরে আফগানিস্তানের তৎকালীন তালেবান সরকার এই আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদাকে মদত দিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। তদুপরি তৎকালীন বুশ প্রশাসন থেকে বলা হয় আফগান তালেবানের উদ্দেশেÑ‘আমাদের সোনার কার্পেটের প্রস্তাবটি মেনে নাও, আর নয়তো বোমার কার্পেটের নিচে তোমাদের কবর রচিত হবে।’ অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই অভিযানে সমর্থন দেয় তার পশ্চিমা মিত্ররা। অভিযানে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পতন ঘটে। তবে আফগানিস্তানে তালেবান ও আল-কায়েদা সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সেনারাও আফগানিস্তান ছাড়তে পারেননি। তথাপি গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুই হাজার ৩০০ জনের বেশি সেনাসদস্য নিহত হয়েছে এবং ২০ হাজারের বেশি সেনাসদস্য আহত হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিসাধন হয় তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে।
যে যুদ্ধ ২০০১ সালে সংঘটিত হয়েছিল, তারই অবসান ঘটতে যাচ্ছে প্রায় দীর্ঘ ২০ বছর, অর্থাৎ দু’দশক পরে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে। উপরন্তু গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের আগেই আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সেনা প্রত্যাহার করে নেবেন। এরই মধ্যে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে শান্তিচুক্তি হয়েছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই সেনা প্রত্যাহার। তবে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো সেনা প্রত্যাহার আফগানদের জন্য একটি চমৎকার ভবিষ্যৎ গঠনের সুযোগ এনে দেবে, নাকি আফগানদের ভবিষ্যৎ আরও কোণঠাসা হয়ে যাবে, সেই প্রশ্নটিও যেন রয়েই যায়। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বরের আগেই দু’দশকের এই সংঘাতকে অতি সহজভাবে অনেক পশ্চিমাপন্থিরা নিলেও মূলত এই সেনা প্রত্যাহার একটি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার পরিচয়ও বহন করছে।
তবে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রকে চতুর্মাত্রিক সংকটে ফেলে দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। উপরন্তু আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের ফলে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকা সেই তালেবান আবার ভবিষ্যতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, ঘটাতে পারে বিভিন্ন জঙ্গি কার্যক্রম। তালেবানের ভাষা থেকে মূলত এটি আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। তালেবান যোদ্ধাদের ভাষায় ‘আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং শত্রুকে পর্যুদস্ত না করা পর্যন্ত তরঙ্গের পর তরঙ্গ আকারে এগিয়ে যাই।’ যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে এসব তালেবান যোদ্ধারা হামলা চালালে তা আবার য্ক্তুরাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে যাবে। কেননা তালেবানকে অস্ত্র মজুত দিয়ে থাকে রাশিয়া। আবার চীনের ব্যবসায় বা চীনের কার্যক্রমে তালেবান কখনও বাধা প্রদান করে না।
আবার ইরান শিয়াপন্থি হলেও পারিপার্শ্বিকভাবে আঁতাত আছে ইরান-তালেবানের। সর্বোপরি সার্বিক বিশ্লেষণ করলে বোধগম্য হওয়া যায়, তালেবানের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে ইরান, রাশিয়া ও চীন। এছাড়া পাকিস্তানের কথাও শোনা যায়। অভিযোগ আছে, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে তালেবানকে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। উপরন্তু এই দেশগুলো যদি সংঘবদ্ধভাবে তালেবানের উত্থানে সাহায্য করে, তাহলে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ একটি নয়া পন্থায় পরিবর্তিত হবে। প্রসঙ্গত, বিচ্ছিন্নভাবে আফগানে তৎপরতা চালাচ্ছে তালেবান। সেখানে ন্যাটোর বাহিনী ও ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী মোতায়েন করা হলেও বছর শেষে সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। যদিও রাজনৈতিক কাঠামোর সেখানে জন্ম হয়েছে, তবে আফগান জাতিকে একত্রিত হয়নি। স্পষ্টতই হামিদ কারজাই সরকার আফগানিস্তানের সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
অন্যদিকে আফগানিস্তান দেশটি থেকে মার্কিনিদের নেতৃত্বে ন্যাটো সৈন্যরা চলে গেলে কাবুল হামিদ কারজাই বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেবে তুরস্ক। কিন্তু তালেবান চাচ্ছে মুক্ত আফগানিস্তান, যেখানে তারা একাই রাজত্ব কায়েম করবে। তারা খুব একটা চাচ্ছে না যে, তুরস্ক তাদের মধ্যে আবার হস্তক্ষেপ করুক। উপরন্তু এতে আফগানিস্তানে ভবিষ্যতে তুরস্কের সঙ্গে তালেবানের একটা যুদ্ধও হতে পারে। তবে এটা আবার ভবিষ্যতে তুরস্ক-তালেবান সমঝোতা করে নয়া মোড়ও সৃষ্টি করতে পারে।
তদুপরি আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র চলে গেলে সেখানে কি আদৌ শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে এমন প্রশ্ন নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন? তথাপি মনে হয় না এই শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। কেননা এখানে রয়েছে তালেবানের দু’দশকের ক্ষোভ! বস্তুত আফগানিস্তান বিভিন্ন খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। এগুলো লুট করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র দোষী। সুতরাং এই বিষয়বলি থেকেও তালেবান আবার সহিংসতার পথ বেছে নিতে পারে ভবিষ্যতে। আবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তালেবানের সদস্য নিহত হওয়ায় বা প্রতিশোধের যে বিষয়টি রয়েছে, সেটিও উল্লেখ করা যেতে পারে। তার জেরেও আফগান তালেবানরা সহিংসতার পথ বেছে নিতে পারে। এবার প্রশ্ন হতে পারে, ভবিষ্যতে নতুন ক্ষমতার কি পালাবদল হবে না আফগানিস্তানে? আশঙ্কা করা যায়, আফগানিস্তানের রাজনীতিতে তালেবানের উত্থান হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিতে দীর্ঘদিন তালেবান ক্ষমতাচ্যুত ছিল। সর্বোপরি তালেবান কি ভবিষ্যতে সেখানে সংযম বজায় রাখবে, নাকি অন্য ভয়ংকর কিছু ঘটাবে?
যা-ই ঘটুক, নিশ্চিত ভালো কিছু হবে বলে মনে হয় না। আবার যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি সেখানে না থাকলে আফগানিস্তানে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে সন্ত্রাসবাদ, হত্যাকাণ্ড কিংবা জঙ্গিবাদ। উপরন্তু আফগানিস্তান ছেড়ে যদি এখন চলেও যায়, পরে আফগান ঘিরে শক্ত ঘাঁটি স্থাপিত হবে তালেবান বা আইএসের। উপরন্তু তালেবানের দাবি, তারা এখন আফগানিস্তানের ৭০ শতাংশের বেশি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে আফগানিস্তানের একটি সংবাদ সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, তালেবান অন্তত ৫২ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এছাড়া আফগানিস্তানের চারদিকে রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সুতরাং তারাও আফগানে ক্ষমতা প্রদর্শন করবে, যা আফগানিস্তানের ভবিষ্যতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার ঘোষণা দিতে না দিতেই আফগানিস্তানের পূর্ব অঞ্চলে নাঙ্গারহার প্রদেশের একটি মসজিদে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে একই পরিবারের আট সদস্য নিহত হয়েছেন (১৯ এপ্রিল, ডেইলি স্টার)। এছাড়া গণমাধ্যমের তথ্যমতে, তালেবানের হামলায় গত শেষ সপ্তাহে ২৯ জন নিহত হয়েছেন। উপরন্তু এসব হত্যা ও সংঘাত দেখে নির্দ্বিধায় বলা যায়, আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। এছাড়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ছয় মাসের মধ্যেই তালেবান কাবুল দখল করে নেবে। আর এজন্যই ১১ সেপ্টেম্বরের পরেও কিছুসংখ্যক (৬৫০ জন) যুক্তরাষ্ট্রের সেনা আফগানিস্তানে থাকবে। অতঃপর এই যুক্তরাষ্ট্রের সেনা আফগানিস্তানে থাকবে, এ বিষয়টি নিয়ে তালেবানও বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তদ্রƒপ আবারও নিঃসন্দেহে বলা যায়, এসব পরিপ্রেক্ষিত বিষয়গুলোও আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ ক্ষেত্রে শান্তি বা উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় কিছু আনবে বলে মনে হয় না।
আফগানিস্তান ছাড়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন পন্থায় আফগান ইস্যুতে সংযুক্ত থাকতে চায়। এসব পন্থার মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি, মানবিক সহায়তা, কূটনীতি প্রভৃতি। তবে যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা আফগানে শান্তি প্রতিষ্ঠা না করলে এগুলো কীভাবে কী সম্ভব হবে, তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। উপরন্তু যদিও সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের পরিবেশ স্থিতিশীল হবে না, বরং তা ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। পক্ষান্তরে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতাও আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেতে পারে। পক্ষান্তরে যেমনটা হয়েছিল, গত শতকের আশির দশকে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পর, অনেকটা তেমনও হতে পারে।
আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটা রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে আফগানিস্তানে সিরিয়ার মতো রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। তবে আবার যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার হওয়ার পরে তালেবান কিংবা গনি সরকার যে কেউই ক্ষমতায় এলে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক কিংবা বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণ করে আফগানিস্তান ভবিষ্যতের জন্য সুবিধাজনক অবস্থান অর্জন করতে পারে।
আফগানিস্তানের পরিস্থিতি যদি একপক্ষীয়ভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় আসে, তবে এর সৌন্দর্যময় পর্যটন কেন্দ্র, কৃষিপণ্য ও ফল রপ্তানি প্রভৃতি আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎকে সুউচ্চে নিয়ে যেতে পারে। যদিও তালেবান সংঘাতে এসব বিষয় অনেকখানি চাপা পড়ে ছিল। এছাড়া আফগানিস্তানের যুবারা বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে (ক্রিক্রেট, ফুটবল প্রভৃতি) উল্লেখ্যযোগ্য অবস্থানে পদার্পণ করেছে। যদি কাবুলের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে এ ক্ষেত্রেও আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সদা উজ্জ্বল হবে। এখন শুধু সেনা প্রত্যাহারের জন্য অপেক্ষার প্রহর গোনার পালা। এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়