আফ্রিকার অর্থনৈতিক বিপ্লবের চাবিকাঠি কফি

জান্নাতুল ফেরদৌস তামান্না: নবম শতাব্দীতে কালদি নামে একজন ইথিওপিয়ান পশুপালক মাঠে ছাগল চারণের সময় অদ্ভুত কিছু লক্ষ করেন। তিনি দেখেন একটি নির্দিষ্ট গাছের ফল খাওয়ার পর তার ছাগলগুলো শক্তি অর্জন করে এবং লাফাতে শুরু করে। এটি দেখে তার কৌতূহল জাগে। তাই তিনি ও তার বন্ধু কিছু ফল খান। তেতো স্বাদের কারণে ফলগুলোকে আগুনে ফেলে দেন তারা। সঙ্গে সঙ্গে তারা উত্তেজনাময় সুবাস পান, যা তাদের বিস্মিত করে। তাই তারা আগুন থেকে ফলগুলো তুলে পানিতে ভিজিয়ে রেখে পান করেন। এভাবে তারাই প্রথম কফিতে চুমুক দেন।

আফ্রিকার দেশগুলো তখন থেকে বিশ্বশিল্পের একটি উল্লেখযোগ্য ফসল নিয়ে ব্যবসা শুরু করে, যা বর্তমানে কোটি মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের শীর্ষ ২৫ কফি উৎপাদকদের মধ্যে রয়েছে এ মহাদেশের ক্যামেরুন, ইথিওপিয়া, আইভরি কোস্ট, কেনিয়া, তানজানিয়া ও উগান্ডা। অ্যাঙ্গোলা, ঘানা, লাইবেরিয়া, বুরুন্ডি, জাম্বিয়া, সাও টোমে ও প্রিন্সিপ এবং সিয়েরা লিওনসহ আরও কয়েকটি দেশ তাদের বাজার সম্প্রসারণ করেছে। দুর্ভাগ্যবশত আফ্রিকার কফিচাষিরা তাদের প্রাপ্য পাবেন বলে কোনো নিশ্চয়তা নেই।

মহাদেশটির মধ্যবিত্তদের ক্রমাগত চেষ্টার ফলে আফ্রিকার চারপাশে কফি পছন্দের পানীয় হয়ে উঠছে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কফি রপ্তানি হবে আনুমানিক ১৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের। তবে আফ্রিকার কৃষকরা কফি ও অন্যান্য ফসলের এই অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবেন কি না, তা সম্পূর্ণভাবে আফ্রিকান কন্টিনেন্টাল ফ্রি ট্রেড এরিয়ার (এএফসিএফটিএ) গতিবিধির ওপর নির্ভর করছে। জোটটি সম্পূর্ণভাবে কার্যক্রম শুরু করতে পারলে পণ্য ও পরিষেবার জন্য এটি হবে বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য এলাকা, যেখানে ৫৪ দেশের ১৩০ কোটি গ্রাহক যুক্ত হবেন। জাতিসংঘের কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) অনুমান, এএফসিএফটিএ বর্তমানের আন্তঃআফ্রিকান ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ রপ্তানি বাণিজ্যকে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারবে এবং মহাদেশটির ৫১ শতাংশ বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারবে। সমস্যা হলো খুব কম কৃষকই জানেন, এফসিএফটিএ কী, এটি তাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারে।

আফ্রিকা নো ফিল্টারের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালে নাইজেরিয়ার ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি আকারের উদ্যোগগুলোর মধ্যে কৃষি খাতে এএফসিএফটিএ সম্পর্কে সচেতনতা মাত্র তিন শতাংশের মতো ছিল। মহাদেশটির বৃহত্তম কফি উৎপাদনকারী অঞ্চল পূর্ব আফ্রিকার মাত্র ১৪ শতাংশ বেসরকারি ব্যবসায়িক খাত এএফসিএফটিএ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল। অনুমান করা হচ্ছে, এএফসিএফটিএ সচিবালয় সম্প্রতি মহাদেশের কফি মূল্যশৃঙ্খলের উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য আন্তঃআফ্রিকান কফি সংস্থার সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু বেশিরভাগ আফ্রিকার কফিচাষি ও ৮০ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। ব্যবসায়িক খবরের মাত্র এক শতাংশ জোট-সম্পর্কিত। অথচ গণমাধ্যমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে এটি। গত বছর এএফসিএফটিএ সচিবালয় ও ইউএন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম এক প্রতিবেদনে জানায়, কোথায় বিনিয়োগ করা উচিত তা নিয়ে গণমাধ্যমে কম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

এএফসিএফটিএ-সম্পর্কিত উন্নয়নের সঙ্গে যদি ভোক্তা, উদ্যোক্তা ও ব্যবসার একটি বৃহৎ অংশ তাল মিলিয়ে চলতে না পারে বা এটি কীভাবে বিকশিত করা উচিত সে সম্পর্কে আলোচনায় অংশ নিতে না পারে, তাহলে চুক্তিটি অন্যান্য উদ্যোগের মতোই শুধু বিশেষ সুবিধাভোগী কিছু গোষ্ঠীকে সাহায্য করবে। অর্থাৎ বৃহৎ জনগোষ্ঠী এর সুযোগ ও সুফল সম্পর্কে অবগত নয়। জোটের সমালোচনামূলক দিকগুলোয় গুরুত্ব দেয়া হলে আফ্রিকার অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের বড় ক্ষতি হতে পারে। এই পরিণতি এড়াতে সরকারের উচিত এর ইতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে জনগণকে জানানো এবং এতে তাদের যুক্ত করা। কভিড-১৯ মহামারি শুরু হওয়ার সময় যে ধরনের ‘সচেতনতা কর্মশালা’ চালু করা হয়েছিল, সে ধরনের সচেতনতা আবার তৈরি করার জন্য সরকারকে জোট ও অন্য অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করা উচিত। এই সচেতনতা তৈরির লক্ষ্য হবে, সব অংশীদারদের বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি আকারের উদ্যোগের কাছে জোট সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানানো এবং সহজ ভাষা ব্যবহার করে আন্তঃবাণিজ্যকে যেভাবে সহজীকরণ করা হচ্ছে, তা জানানো। এছাড়া সব তথ্য যেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসায় ও ভোক্তাদের কাছে জোটের গুরুত্ব তুলে ধরা উচিত। যেমন ইথিওপিয়ার হারার শহরের এক কফিচাষিকে অবশ্যই বুঝতে হবে, বতসোয়ানায় বিকাশমান কফি সংস্কৃতির কারণে বৃহৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে তাদের একটি সম্ভাব্য বাজার রয়েছে এবং কীভাবে এএফসিএফটিএ তাদের সে বাজার ধরতে সহায়তা করতে পারে।

আফ্রিকার অর্থনীতির বেশিরভাগ খনিজ, কৃষি ও বন্যপ্রাণির ওপর নির্ভর করায় এএফসিএফটিএ’র জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এক থেকে চার ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছালে মহাদেশটির সামগ্রিক জিডিপি দুই দশমিক ২৫ থেকে ১২ দশমিক ১২ শতাংশ হ্রাস পাবে এবং পশ্চিম, মধ্য ও পূর্ব আফ্রিকাকে এই পতনের ধাক্কা বহন করতে হবে বলে জাতিসংঘের আশঙ্কা। তাই টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য বাণিজ্যকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। আফ্রিকান ইউনিয়নের এজেন্ডা ২০২৩-এ এএফসিএফটিএ’র বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। কেননা এর একটি কৌশলগত কাঠামো হলো, মহাদেশটির অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন করা এবং টেকসই পরিবেশ ও জলবায়ুরোধী অর্থনীতি এবং সম্প্রদায় তৈরির গুরুত্বের ওপর জোর দেয়া। এই চুক্তির যে বিশাল প্রভাব রয়েছে, তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারগুলোর উচিত জাতীয় পর্যায়ের পদক্ষেপ নিয়ে এবং কৌশল অবলম্বন করে এএফসিএফটিএ বাস্তবায়ন করা। পাশাপাশি আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠানগুলোরও উচিত আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, আফ্রিকান এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক ও আফ্রিকার উন্নয়নের জন্য নতুন অংশীদারিত্বের মতো সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করা, যাতে অবকাঠামো বিনিয়োগের মতো আন্তঃআফ্রিকান বাণিজ্য প্রভাবিত হয়।

আফ্রিকানদের একটি অভিন্ন ইতিহাস ও লক্ষ্য রয়েছে এই নীতিটি আফ্রিকার দেশগুলোর সরকার, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বোঝা উচিত। এটি এএফসিএফটিএ’র বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে এবং এর সুফল বাড়াতে সাহায্য করবে। ক্ষুদ্র কৃষক থেকে শুরু করে উদ্যোক্তাদের কেপটাউন থেকে কায়রো পর্যন্ত ব্যবসা পরিচালনার জন্য এএফসিএফটিএ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং এর সুবিধাগুলো নিতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০