নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংকঋণে এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়নে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার গত বছরের এপ্রিলে। এজন্য ব্যাংক উদ্যোক্তারা ব্যাংক খাত থেকে পাঁচ ধরনের সুবিধা নিয়েছিলেন, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। এবার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানিয়ে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন সব ঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। অপরদিকে আমানতের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ছয় শতাংশ।
গতকাল গুলশানে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) কার্যালয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে বেসরকারি খাতের ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা অংশগ্রহণ করেন।
বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের জানান, গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন অর্থনীতির স্বার্থে সব ঋণেই সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে। এটি নিয়েই মূলত ব্যাংকার ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক।
অর্থমন্ত্রী বলেন, এক অঙ্ক সুদহার বাস্তবায়নে ব্যাংকাররা তিন মাস সময় চেয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে দুই মাস সময়ের কথা বলা হয়েছিল। তারা জানিয়েছেন, কিছু আমানত এ সময়ে মেয়াদোত্তীর্ণ হবে। এজন্য তারা এক মাস সময় বেশি চেয়েছেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, এই সুদহার সব ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এমনকি ব্যক্তিগত ঋণের বেলায়ও। শুধু ক্রেডিট কার্ডের বেলায় এটি প্রযোজ্য হবে না।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এক অঙ্ক সুদহারের প্রজ্ঞাপন বাংলাদেশ ব্যাংক জারি করবে। এর পর থেকেই নতুন-পুরোনো সব ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে নামবে।
এক অঙ্কে সুদহার নামিয়ে আনতে ব্যাংকগুলোকে নতুন কোনো সুবিধা দেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারের বিভিন্ন তহবিলের ৫০ শতাংশ এখন থেকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো পাবে। এটির সুদহার হবে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সাড়ে পাঁচ শতাংশ সুদে সরকারি আমানত পেলে বেসরকারি ব্যাংক তা ছয় শতাংশে নেবে।
সরকারি অর্থ সব ব্যাংক সমান হারে পাবে না। ব্যাংকের মূলধন অনুপাতে এটি দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। আগে সিদ্ধান্ত ছিল শুধু উৎপাদন খাতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সব ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহার হবে। কোনো ব্যাংকই ছয় শতাংশের বেশি আমানত নিতে পারবে না।
সরল সুদহারের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, এই ঘোষণার মধ্যেই সবকিছু হবে।
ঘোষণা দিয়েও গত দেড় বছরে এটি বাস্তবায়ন করা হয়নি, এবার কীভাবে হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, গত বছরে ঘোষণা দিয়েও বাস্তবায়ন করা যায়নি, কিন্তু এবার বাস্তবায়ন করা হবে।
ব্যাংকঋণে উচ্চ সুদহার খেলাপি বৃদ্ধি হওয়ার অন্যতম কারণ বলে দাবি করে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এজন্য সুদহার কমিয়ে আনতে ব্যাংক উদ্যোক্তারা গত বছর পাঁচটি সুবিধা নেন, কিন্তু দেড় বছরেও তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেননি। বর্তমানে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংক নির্দিষ্ট কিছু ঋণে ১০ শতাংশের নিচে সুদ নিচ্ছে।
পুনঃতফসিল ঋণেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ১০ শতাংশের নিচে সুদহার নির্ধারণ করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া এক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তারা এটি করছে। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপিরা ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন। কেউ চাইলে এককালীন পরিশোধ করে ঋণমুক্ত হতে পারবেন। সে ঘোষণায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বেশি আবেদন পড়েছে। কিন্তু কোনো ব্যাংকেই বড় খেলাপিরা সুবিধাটি নিতে আসেননি।
এতদিন সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় ব্যাংকগুলোকে মৌখিকভাবে বলা হয়েছিল সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার জন্য। কিন্তু এ বিষয়ে লিখিত কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি কোনো পক্ষ থেকে। এজন্য এটি বাস্তবায়ন করেনি বেসরকারি খাতের অধিকাংশ ব্যাংক।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এতে দেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে। ব্যাংকের মুনাফা একটু কমলেও শিল্প উপকৃত হবে, যার ফল ব্যাংকগুলোও পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানত রয়েছে ১১ লাখ ছয় হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এ আমানতের প্রায় ২৪ শতাংশ হচ্ছে সরকারি।
উল্লেখ্য, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। এর বাইরে পুনঃতফসিল ও রাইট অফ মিলিয়ে ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।