Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 2:18 pm

আবারও বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর উদ্যোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত অর্থবছর রেকর্ড আট হাজার কোটি ১৪১ টাকা লোকসান গুনেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করায় এ লোকসান দিতে হয়েছে। তাই লোকসানের বোঝা কমাতে বাল্ক (পাইকারি) মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে পিডিবি। পাশাপাশি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবও করেছে বিতরণকারী সংস্থা ও কোম্পানিগুলো, যদিও বিতরণ পর্যায়ে মুনাফা রয়েছে প্রতিটি সংস্থা ও কোম্পানির।

এর আগে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছিল। তখন গড়ে ইউনিটপ্রতি ৩৫ পয়সা মূল্য বাড়ানো হয়, যা ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়।

তথ্যমতে, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ওপর গণশুনানি শুরু হচ্ছে আগামীকাল। এদিন পিডিবির বাল্ক মূল্যহার ও পিজিসিবির (পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ) সঞ্চালন মূল্যহার পরিবর্তনের প্রস্তাবের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ১ ডিসেম্বর পিডিবির পাশাপাশি নেসকোর (নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি) খুচরা মূল্যহারের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

তৃতীয় দিন অর্থাৎ ২ ডিসেম্বর ঢাকার দুই বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানি ডিপিডিসি (ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) ও ডেসকো (ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি) প্রস্তাবের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। আর শেষ দিন অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) প্রস্তাবের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। গত মাসেই এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) জমা দিয়েছে প্রতিটি সংস্থা ও কোম্পানি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন মুনাফা থাকলেও বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধি হলে বিতরণকারী সংস্থা ও কোম্পানিগুলো লোকসানের মুখে পড়বে। তাই বাল্ক মূল্য বৃদ্ধির অনুপাতে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকৃত খুচরা বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী জানুয়ারি থেকে নতুন মূল্যহার কার্যকরের প্রস্তাব করা হয়েছে।

পিডিবির বাল্ক মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি ও সরবরাহের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর জুলাইয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে এ হার ৪১ শতাংশ। এতে ২০২০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়বে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এছাড়া গত জুলাইয়ে কয়লার ওপর পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি তরল জ্বালানিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে সাত হাজার ৯২০ কোটি ৬২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ সরবরাহে পিডিবির ব্যয় হবে ৪৫ হাজার ২০৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। সঞ্চালন লস বাদ দিয়ে ২০২০ সালে পিডিবির বাল্ক বিদ্যুৎ বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে সাত হাজার ৬৮৩ কোটি তিন লাখ ইউনিট। এতে পিডিবির সম্ভাব্য আয় দাঁড়াবে ৩৬ হাজার ৬৪৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা। আর সংস্থাটির ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় আট হাজার ৫৬০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।

২০২০ সালে পিডিবির বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে পাঁচ টাকা ৮৮ পয়সা। তবে সে সময় বাল্ক ট্যারিফ আরও কমে দাঁড়াবে চার টাকা ৭৭ পয়সায়। এতে প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি দাঁড়াবে এক টাকা ১১ পয়সা। এ ঘাটতি মেটাতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন ২৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। এজন্য বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার পরিবর্তনের অনুরোধ করেছে পিডিবি।

প্রস্তাবে আরও কিছু বিষয় তুলে ধরেছে পিডিবি। এর মধ্যে রয়েছেÑখুচরা মূল্যহারের মতো বাল্ক ট্যারিফেও প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের ওপর ডিমান্ড চার্জ আরোপ করা। এছাড়া ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতের একটি মধ্যমেয়াদি চিত্র তুলে ধরে মাল্টিইয়ার ট্যারিফ প্রবর্তনের প্রস্তাবও করেছে পিডিবি। এক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে ২০২৫ সাল নাগাদ পিডিবির লোকসান বেড়ে তিনগুণ হবে।

বাল্ক বিদ্যুৎ বৃদ্ধির প্রস্তাব করলেও শিল্প গ্রাহকদের ট্যারিফ কিছুটা কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ক্যাপটিভ নিরুৎসাহিত করতে বিইআরসিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এর বাইরে ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও এলএনজি আমদানি মূল্য পরিবর্তনের ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ১০ শতাংশের কম বাড়লে তা সমন্বয়ের ক্ষমতা পিডিবিকে দেওয়ার প্রস্তাবও করা হয়েছে। পিডিবির বিনিয়োগের ওপর এবারই প্রথম রিটার্ন অন রেট বেজ ধরা হয়েছে, যার পরিমাণ চার দশমিক ৫৮ শতাংশ।

পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গত ১২ অক্টোবর পিডিবি, বিইআরসি ও বিদ্যুৎ বিভাগের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে গত অর্থবছরে বিদ্যুতে ভর্তুকি ও লোকসান বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। সভায় পিডিবিকে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠাতে বলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আগামী বছরের শুরু থেকে বর্ধিত মূল্যহার কার্যকরের সম্ভাবনার কথাও সভায় জানানো হয়। এজন্য এবার পঞ্জিকা বছরভিত্তিক প্রস্তাব করা হয়েছে।

তারা আরও জানান, বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার কতটা বাড়বে তা নিশ্চিত নয় বলে এবার সরাসরি তা প্রস্তাব করা হয়নি। বরং প্রস্তাব কিছুটা ভিন্ন ধরনের করা হয়েছে। এতে কয়েক বছরের বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের মনোভাব যাচাই করে দেখবে বিইআরসি। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর ও আগামী অর্থবছর অর্থ মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ খাতে কতটা ভর্তুকি দিতে চায়, তা বিবেচনা করে মূল্যহার সমন্বয় করবে কমিশন। আর বাল্ক মূল্য অনুপাতে গ্রাহক পর্যায়ে মূল্যও বৃদ্ধি করা হবে।