ইসমাইল আলী: গত তিন দশকে দেশে আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ১৩ বার। তবে গত কয়েক বছরে এ বৃদ্ধির হার ছিল অনেক বেশি। এর মধ্যে পৌনে সাত বছরে প্রায় আড়াইগুণ হয়েছে আবাসিকে গ্যাসের মাসিক দাম। এতে সাধারণ গ্রাহকদের ওপর চেপেছে দামের বোঝা। যদিও বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। বিল দিলেও নিয়মিত গ্যাস পান না গ্রাহকরা।
এদিকে বাসাবাড়িতে গ্যাসের বিল আদায় করা হয় বেশি হারে। তিতাস গ্যাসের হিসাবে দেখা গেছে, মিটারযুক্ত গ্রাহকরা মাসে গ্যাস ব্যবহার করে গড়ে ৪০-৪৫ ইউনিট। কিন্তু মিটারবিহীন গ্রাহকদের থেকে বিল নেয়া হয় মাসে এক চুলায় ৭৩ ইউনিট ও দুই চুলায় ৭৭ ইউনিট হিসাবে। তবে গত রোববার গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তা কিছুটা কমানো হয়েছে। এক্ষেত্রে এক চুলায় ৫৫ ইউনিট ও দুই চুলায় ৬০ ইউনিট ধরে মাসিক বিল নির্ধারণ করা হয়েছে।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির তিন দশকের হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৯১ সালে একমুখী চুলার মাসিক বিল ছিল ১১৫ টাকা। দুই দফা বৃদ্ধির পর ১৯৯৪ সালে তা দাঁড়ায় ১৬০ টাকা। অর্থাৎ বিএনপির শাসনামলের পাঁচ বছরে একমুখী চুলায় গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪৫ টাকা। ওই সময়ে দ্বিমুখী চুলার বিল বাড়ে ৫৫ টাকা। ১৯৯১ সালে এই শ্রেণির গ্রাহকদের গ্যাসের দাম ছিল ১৯৫ টাকা। ১৯৯৪ সালে তা দাঁড়ায় ২৫০ টাকা।
এছাড়া ওই সময় মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ২৬ পয়সা। এতে ঘনমিটারপ্রতি গ্যাসের দাম দাঁড়ায় ২ টাকা ৯০ পয়সা। ১৯৯১ সালে এ দাম ছিল দুই টাকা ৬৪ পয়সা।
এরপর আওয়ামী লীগের শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) একমুখী চুলার ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ৫০ টাকা ও দ্বিমুখী চুলার ক্ষেত্রে ১২০ টাকা। এর মধ্যে ১৯৯৮ ও ২০০০ সালে দুই দফা বাড়ে গ্যাসের দাম। এতে ২০০০ সালে একমুখী চুলার ক্ষেত্রে বিল বেড়ে দাঁড়ায় ২১০ টাকা ও দ্বিমুখী চুলায় ৩৩০ টাকা। আর মিটার গ্রাহকদের দাম বাড়ানো হয় প্রতি ঘনমিটারে ৯৫ পয়সা। এতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়ে ৩ টাকা ৮৫ পয়সা।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার (২০০১-২০০৬) চার দফা গ্যাসের দাম বাড়ায়। এতে ২০০৫ সালে একমুখী চুলায় গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫০ টাকা ও দ্বিমুখী চুলায় ৪০০ টাকা। অর্থাৎ আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ে যথাক্রমে ১৪০ ও ৭০ টাকা। একইসঙ্গে প্রতিবারই মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। এতে ২০০৫ সালে আবাসিকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪ টাকা ৬০ পয়সা। অর্থাৎ চারবার বাড়ানো হয় প্রতি ঘনমিটারে ৭৫ পয়সা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর মেয়াদের মধ্যে ২০০৮ সালে সিএনজি গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। সে সময় এটি বাড়িয়ে চারগুণ করা হলেও আবাসিকসহ অন্যান্য খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি।
মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালে সব ধরনের গ্যাসের দাম পুনরায় বাড়ানো হয়। তবে পুরো মেয়াদে শুধু একবারই বাড়ে আবাসিকে গ্যাসের দাম। সে সময় আবাসিকে এক ও দ্বিমুখী চুলায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ৫০ টাকা হারে। আর মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের বিল বাড়ানো হয় ঘনমিটারে ৫৬ পয়সা। এতে আবাসিকে গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ায় একমুখো চুলায় ৪০০ টাকা ও দ্বিমুখী চুলায় ৪৫০ টাকা। আর মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৫ টাকা ১৬ পয়সা।
আবাসিকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পুরোনো সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যায় আওয়ামী লীগ সরকারের পরের মেয়াদে। এ সময় মাত্র সাড়ে তিন বছরে আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ে চুলাপ্রতি ৩৫০ টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ২০০ টাকা বাড়ানো হয়। সে সময় একমুখো চুলার বিল দাঁড়ায় ৬০০ টাকা ও দ্বিমুখী চুলায় ৬৫০ টাকা। আর মিটার গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম দাঁড়ায় সাত টাকা।
এরপর ২০১৭ সালের মার্চ আরও ১৫০ টাকা হারে বাড়ে চুলার বিল। এতে একমুখো চুলার বিল দাঁড়ায় ৭৫০ টাকা ও দ্বিমুখী চুলায় ৮০০ টাকা। আর সে সময় মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের বিল বেড়ে দাঁড়ায় ঘনমিটারে ৯ টাকা ১০ পয়সা। অর্থাৎ সাড়ে তিন বছরে মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের গ্যাসের বিল বাড়ে ঘনমিটারে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা।
আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদেও দুই দফা বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। এর মধ্যে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে আবাসিকে এক চুলার মাসিক বিল করা হয় ৯২৫ টাকা ও দুই চুলার ৯৭৫ টাকা। আর মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটারে ১২ টাকা ৬০ পয়সা। এদিকে চলতি মাস থেকে আরেক দফা বাড়ল গ্যাসের দাম। এতে এক চুলার মাসিক বিল দাঁড়িয়েছে ৯৯০ টাকা ও দুই চুলার এক হাজার ৮০ টাকা। আর মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বেড়ে হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে ১৮ টাকা।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত পৌনে সাত বছরে এক চুলার মাসিক বিল প্রায় দুই দশমিক ৪৮ গুণ হয়েছে। আর দ্বিমুখী চুলার মাসিক বিল হয়েছে দুই দশমিক ৪০ গুণ। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মিটারযুক্ত চুলায়। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের খরচ প্রতি ঘনমিটারে প্রায় তিন দশমিক ৪৯ গুণ হয়েছে।
