আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের শুঁটকিবাজার

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: আমদানি করা শুঁটকিতে ভরে গেছে দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি শুঁটকিবাজার চট্টগ্রামের চাক্তাই ও আসাদগঞ্জের মোকামগুলো। অথচ এক সময় চট্টগ্রামের শুঁটকি দিয়ে দেশের ৮০ শতাংশ চাহিদা মিটতো। আর এখন দেশে উৎপাদিত শুঁটকি দিয়ে চাহিদার অর্ধেক মেটে। বাকি শুঁটকি ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করা হয়।
সরেজমিনে দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি শুঁটকিবাজার চট্টগ্রামের চাক্তাই ও আছাদগঞ্জ ঘুরে দেখা যায়, মৌসুম শুরুতে আসতে শুরু করেছে বিভিন্ন জাতের শুঁটকি। গতকাল দুপুরে শুঁটকি বোঝাই ১৫টি ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এসব গাড়িতে ছিল বিভিন্ন জাতের চিংড়ি, রূপচাঁদা, লাখ্যা, কোরাল, পোপাসহ নানা জাতের শুঁটকি। এ বাজারে রাঙাবালির রূপচাঁদা শুঁটকি বিক্রি হয়েছে চার হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা কেজি। আর সোনাদিয়ার রূপচাঁদা বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা কেজি। লাখ্যা শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকায়। উন্নতমানের লাখ্যা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে চার হাজার টাকারও বেশি দামে। রাঙাবালির কোরাল শুঁটকির দাম সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা কেজি। সোনাদিয়ার কোরাল দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। ছুরি শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি মান ও আকারভেদে চারশ থেকে এক হাজার দুইশ টাকা পর্যন্ত। লইট্টা বিক্রি হচ্ছে দুইশ টাকা থেকে চারশ টাকা পর্যন্ত। বিভিন্ন জাতের চিংড়ি মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ছয়শ থেকে এক হাজার দুইশ পর্যন্ত। নোনা ইলিশ প্রতিটি তিনশ হতে চারশ টাকা। এছাড়া ফাইস্যা ৪৫০ থেকে ৭০০ টাকা, পোপা শুঁটকি ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা, রিসকা ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা, চাপা সুরমা ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি মিয়ানমার, পাকিস্তান ও ভারতীয় বিভিন্ন ধরনের শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা বিক্রেতারা চাক্তাই ও আছাদগঞ্জের মোকামগুলো থেকে শুঁটকি নিয়ে যান ভোক্তাদের কাছে। প্রতিদিন ভোর থেকে এখানে কেনাবেচা শুরু হয়, চলে রাত অবধি। এ বাজারে শুঁটকি বিক্রির জন্য ৪০টি আড়ত, আড়াই শতাধিক পাইকারি দোকান এবং দু’শতাধিক খুচরা ও ভাসমান দোকান রয়েছে। অধিকাংশ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাগরে মাছের সংখ্যা কমে আসায় দিন দিন আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে দেশের শুঁটকির বাজার।
বড় বড় পাইকারি আড়তে ২০ থেকে ২৫ ধরনের শুঁটকি পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, রূপচাঁদা, লাখ্যা, কোরাল, পোপাসহ কয়েক ধরনের শুঁটকির দাম কিছুটা বেশি। আবদুল আলিম নামের একজন খুচরা বিক্রেতা বলেন, এখন নতুন শুঁটকির মৌসুম। রাঙ্গুনিয়া থেকে এসেছি শুঁটকি কিনতে। কিন্তু দাম বেশি। বেশি দামে শুঁটকি কিনলে বেশি দামে বিক্রি করতে হবেÑএটা তো আর ক্রেতা বুঝবে না। তাই আধাবেলা ঘুরেও প্রত্যাশানুসারে বাজার করতে পারিনি।
ব্যবসায়ী সমিতির তথ্যমতে, বর্তমানে প্রতিবছর দেশে শুঁটকির চাহিদা প্রায় সাড়ে ৫৫ হাজার টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ২০ হাজার টনের মতো। বাকি প্রায় ৩৫ হাজার টন শুঁটকি আমদানি করতে হয় মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্তান থেকে, যা মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ।
আমদানিকারকরা জানান, পাঁচ বছর আগেও স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশি শুঁটকির বড় অংশ বিভিন্ন দেশে রফতানি হতো। ২০০১-০২ অর্থবছরে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে শুঁটকি রফতানির পরিমাণ ছিল প্রায় চার হাজার টন। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে তা কমে এসে দাঁড়ায় তিন হাজার টনে। ২০০৭ সাল থেকে শুঁটকির উৎপাদন কমতে শুরু করে। পাশাপাশি রফতানিও কমে আসে। ২০১১-১২ অর্থবছরে শুঁটকি রফতানি হয়েছে মাত্র ১৫০ টন। একই বছর আমদানি হয়েছে ৫৩৬ টন। বর্তমানে রফতানির পরিমাণ একশ টনে নেমে এসেছে। আর আমদানির পরিমাণ বেড়েছে বহুগুণ। পাইকারি শুঁটকি ব্যবসায়ী মো. মুছা জানান, বড় ট্রলারে মাছ ধরার কারণে সাগরে মাছের সংখ্যা কমে আসছে। এসব ট্রলারের জালে জাটকা নিধন চলে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছও মরে যায়। এতে সাগরে মাছের আকাল চলছে। তাই শুঁটকির জোগানও কমে যাচ্ছে। অপরদিকে খুচরো শুঁটকি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আক্কাস গাজী বলেন, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, হাতিয়া, সোনাদিয়া, কক্সবাজার, টেকনাফ, সুন্দরবন, সুন্দরবন সংলগ্ন দুবলারচর, কুয়াকাটাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে শুঁটকি এ বাজারে আসে। এর মধ্যে সোনাদিয়া, রাঙাবালি ও দুবলারচর এলাকা থেকে আসা শুঁটকির স্বাদ অতুলনীয়। এখানে নানা জাতের শুঁটকির মধ্যে বিক্রি বেশি হয় লাখ্যা, কোরাল, রূপচাঁদা, ছুরি, ফাইস্যা, লইট্টা ও পোয়া।
আছাদগঞ্জ শুঁটকি আড়তদার সমিতির সভাপতি শফিউল আলম বলেন, দেশে উৎপাদিত শুঁটকির গুণগত মান ভালো, স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। তাই মধ্যপ্রাচ্য, লন্ডনসহ অনেকগুলো দেশে চট্টগ্রামের শুঁটকির চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে দেশে তৈরি শুঁটকির ২০ শতাংশ এসব দেশে রফতানি হচ্ছে।
আছাদগঞ্জ শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য ও রাঙাবালি বিডিডটকমের উদ্যোক্তা মোস্তফা শফিউল বলেন, এক সময় এখানকার শুঁটকি দিয়ে দেশের ৮০ শতাংশ চাহিদা মেটানো হতো। এখন দেশে উৎপাদিত শুঁটকি দিয়ে চাহিদার অর্ধেক মেটানো হয়। অবশিষ্ট শুঁটকি ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করা হয়। তবে চট্টগ্রামের শুঁটকির স্বাদ ও গন্ধ আলাদা।
আছাদগঞ্জ শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরিদ আহমদ বলেন, এ পাইকারি বাজারে ৪০টি শুঁটকির আড়ত ও ২৬৮টি পাইকারি দোকান রয়েছে। আড়ত ও দোকান মিলে এ মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে বিক্রি দেড়শ টনেরও বেশি। তিনি আরও বলেন, ২০০০ সালের দিকে এখান থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের প্রায় ৩০টি দেশে বছরে চার-পাঁচ হাজার টন শুঁটকি রফতানি করা হতো। বর্তমানে উল্টো সাত-আট হাজার টন শুঁটকি আমদানি করা হয়।

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০