মিশওয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান

আমদানির আড়ালে অর্থপাচার মিশওয়ার হোসিয়ারির

* জাল ও ভুয়া ব্যাংক প্রত্যয়নপত্রে চীন থেকে পণ্য আমদানি

* পাচার সাড়ে ৫ লাখ ডলার, মানিলন্ডারিং মামলার প্রতিবেদন

* রাজস্ব ফাঁকি ১৭ কোটি টাকা, বন্ড সুবিধার অভিযোগে মামলা

রহমত রহমান: মিশওয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান মিশওয়ার হোসিয়ারি মিলস (প্রা.) লিমিটেড (গার্মেন্ট ডিভিশন)।তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। ভুয়া বা জাল এফওসি (ফ্রি অব কস্ট) দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি অর্থপাচার করেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

৯ মাস তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা। সেই প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন শেষে তা আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

অর্থপাচারের বিষয়ে মিশওয়ার হোসিয়ারি মিলস (প্রা.) প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম আহমদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কাস্টমস গোয়েন্দার কিছু ভুল আছে। আপাতত আমরা বন্ডের সঙ্গে কাজ করছি। বন্ড দিয়ে অডিট করাচ্ছি, অডিট কমপ্লিট হলে জানা যাবে কী হয়েছে।’ ভুয়া এফওসি বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা তারা বলতেই পারে। সমস্যা যেহেতু তৈরি হয়েছে, কিছু তো আছে। আমার কথা তো তারা শুনবে না। প্রতিষ্ঠান যেহেতু বন্ডের, আমাকে যেতে হচ্ছে বন্ডে। বন্ডে আমি শুনানি দিয়েছি।’ কাস্টমস গোয়েন্দা আপনার কথা শোনেনি এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনোদিন শুনবে নাকি? তারা যা সমস্যা পেয়েছে, দেখছে, মনে করছেÑস্বাভাবিক তারা লিখবেই। তারা তাদের মতো গেছে, আমি আমার মতো আইনি প্রসেসে যাচ্ছি।’

এনবিআর সূত্র জানায়, ২০০২ সাল থেকে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা আগের বছরের রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ কাপড় এফওসি’র ভিত্তিতে আমদানি করে আসছেন, যার মূল্য পরিশোধ করেন বিদেশি ক্রেতা। এর পরও পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ভুয়া বা জাল এফওসি দেখিয়ে প্রাপ্যতার চেয়ে অতিরিক্ত কাঁচামাল আমদানি করে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানগুলো এফওসির অপব্যবহার করে আসছে বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কাস্টমস গোয়েন্দাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কাস্টমস গোয়েন্দা মিশওয়ার হোসিয়ারিসহ ১৩টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এফওসি সুবিধার অপব্যবহারের প্রমাণ পায়। পরে ২০১৮ সালের ১১ মার্চ মিশওয়ার হোসিয়ারি মিলস (প্রা.) লিমিটেডের (গার্মেন্ট ডিভিশন) ১০টি চালানসহ ১৩টি পোশাক প্রতিষ্ঠানের মোট ৭০টি চালান স্থগিত করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লা কুতুবপুর রামারবাগ এলাকার মিশওয়ার হোসিয়ারি প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট, জগিং স্যুটসহ বিভিন্ন পোশাক উৎপাদন করে তা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে রপ্তানি করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ ও ২০১৮ সালে পাঁচটি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে এফওসি’র মাধ্যমে ১০টি চালানে কাপড় আমদানি করেছে। এসব পণ্য আমদানিতে আমদানি নীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির লিয়েন ব্যাংক আইএফআইসি ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখা। এ প্রতিষ্ঠানকে পণ্য আমদানিতে এ ব্যাংক এফওসি-সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র দিয়েছে কি না, তার তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় কাস্টমস গোয়েন্দা।

ব্যাংক জানায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত কোনো প্রত্যয়নপত্র ইস্যু করা হয়নি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের যে কর্মকর্তার নাম ও সই দেওয়া প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়েছেÑতাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানানো হয়, তিনি এ সই দেননি। জিজ্ঞাসাবাদে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংক থেকে কোনো প্রত্যয়নপত্র নেননি বলে স্বীকার করেন। তবে বিজিএমইএ’র প্রত্যয়নপত্র দিয়ে পণ্য আমদানি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

এনবিআরের এমআইএস সিস্টেম থেকে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ৩৫টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করেছে, যা এফওসি ভিত্তিতে এলসি ছাড়াই বিনা মূল্যে আমদানি করা হয়েছে। চীনের সাতটি কোম্পানি থেকে এসব পণ্য আমদানি করা হয়েছে। আমদানি নীতি লঙ্ঘন করে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটি এফওসির সুবিধার অপব্যবহার করে এসব পণ্য আমদানি করেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সাতটি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ঋণপত্র বা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে পণ্য আমদানির আড়ালে প্রায় ৭৩ হাজার ৩৪৪ ডলার মুদ্রা পাচার করেছে। এছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৮টি বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে প্রায় চার লাখ ৬৯ হাজার ৫৫০ ডলার পাচার করেছে। দুই অর্থবছরে মোট পাচার করেছে প্রায় পাঁচ লাখ ৪২ হাজার ৮৯৫ ডলার। এফওসি সুবিধা দেখিয়ে এসব পণ্য আমদানি করা হয়েছে। পণ্যটি স্বাভাবিকভাবে শুল্কায়ন করে আমদানি করা হলে এর ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর হতো প্রায় ১৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। মিথ্যা ঘোষণা ও বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করায় ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কাস্টমস আইনে মামলা করা হয়।

অপরদিকে মুদ্রা পাচার করে সেই অর্থ দিয়ে পণ্য ক্রয় করে অবৈধ পন্থায় জাল বা ভুয়া এফওসি ব্যবহার করে পণ্য খালাসের চেষ্টা ও খালাস নেওয়ার অভিযোগে এনবিআরের অনুমোদন সাপেক্ষে ২০১৯ সালের ২১ মার্চ রমনা মডেল থানায় মানি লন্ডারিং আইনে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করে কাস্টমস গোয়েন্দা। সহকারী রাজস্ব কাস্টমস বিটন চাকমা বাদী হয়ে এ মামলা করেন। মামলায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম আহমদ, পরিচালক তার মা নুরজাহান বেগম এবং পরিচালক ও ছোট ভাই মো. মহসীন আলীকে আসামি করা হয়। তদন্তে অর্থপাচার ও রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়। সেজন্য তিনজনের বিরুদ্ধে রাজস্ব কর্মকর্তা মুহা. আবদুল কাইয়ুম তালুকদার ১৬ জানুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে দেখা যায়, মিশওয়ারের ঠিকানায় এক্সওটিক নিটওয়্যারস লিমিটেড নামে একটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি বন্ডেড প্রতিষ্ঠান নয়, যার মালিক রুবাইয়াত সাজ্জাদ চৌধুরী। মিশওয়ারের মালিকের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে গার্মেন্টসটি পরিচালিত হচ্ছে। মিশওয়ার বন্ডেড প্রতিষ্ঠান হয়েও কাস্টমস আইন লঙ্ঘন করে তা ভাড়া দিয়েছে। সেজন্য প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০