শেখ আবু তালেব: এক মাসের ব্যবধানে চলতি বছরের আগস্টে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে তিনগুণের বেশি। রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এর ফলে চলতি হিসাবও ঋণাত্মক হয়েছে। তা প্রায় সাড়ে চারগুণ বেড়ে চলে গেছে ঋণাত্মকের ঘরে। আবার বৈদেশিক সহায়তা বৃদ্ধিতে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের স্থিতি বেড়েছে।
বিশ্লেষকরা এমন চিত্রকে উদ্বেগ হিসেবে দেখছেন না; কিন্তু বলছেন, অর্থনীতিতে এক ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে। সতর্ক থাকতে হবে অর্থপাচার হওয়ার বিষয়ে।
বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে প্রতি মাসে তথ্য প্রকাশ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১১ কোটি ৬০ লাখ ডলার, স্থানীয় মুদ্রায় যা ৩৫ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। গত জুলাই মাসে ছিল মাত্র ১৩৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা আট হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে প্রায় তিনগুণ বেড়েছে বাণিজ্য ঘাটতি।
গত অর্থবছরের (২০২০-২১) জুলাই-আগস্টে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল মাত্র ৬৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-আগস্টে রপ্তানি হয়েছে ৬৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। অপরদিকে আমদানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের। এক মাসের ব্যবধানে ৪১১ কোটি ৬০ লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থের বেশি আমদানি হয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে। আমদানি বৃদ্ধি পাচ্ছে মূলত মূলধনি যন্ত্রাংশ এলসির পরিমাণ বেশি হওয়ায়। কিন্তু পরিমাণগতভাবে তেমন একটা বৃদ্ধি পায়নি। আমদানি খরচ বেড়েছে বেশি। এজন্য আমদানি ব্যয় বেশি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রপ্তানির বেলায় উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। পণ্য রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে, কিন্তু পণ্যের দাম কিন্তু কমেছে। এজন্য এক্ষেত্রে পরিমাণ বাড়লেও আয় বৃদ্ধি পায়নি সেভাবে। একই চিত্র দেখা যাচ্ছে পেট্রোলিয়াম পণ্যের আমদানিতেও। আবার প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেও ধীরগতি শুরু হয়েছে। এজন্য ডলারের সংকট বাড়ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেবা খাতেও বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে। পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতির পাশাপাশি এ খাতেও বাংলাদেশের ঘাটতি বেড়েছে। সেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশকে যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করেছে, সে তুলনায় আয় হয়েছে খুবই কম। মূলত ভ্রমণ, বিমা প্রভৃতি খাতের আয়-ব্যয়ের হিসাব কষে বের করা হয় সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ। গত জুলাই-আগস্টে এ খাতে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের, গত জুলাই মাসে যা ছিল মাত্র দুই কোটি ৭০ লাখ ডলারের। সার্বিক উদ্বৃত্তের (ওভার অল ব্যালেন্স) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ কোটি ১০ লাখ ডলারের।
আবার ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে স্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৭১ কোটি ১০ লাখ ডলার, গত জুলই মাসে যা ছিল মাত্র সাত কোটি ৬০ লাখ ডলারের। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে যা ছিল ঋণাত্মক ১০৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের স্থিতি বেশি হওয়ার বিষয়টি মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে উদ্বেগের কিছু দেখছেন না অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমানে বৈদেশিক সহায়তা আসছে। এটি যোগ হচ্ছে। এখন আমাদের বৈদেশিক সহায়তাটির গুণগত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু কাঠামোগত যে পরিবর্তন শুরু হয়েছে, এক মাসের মধ্যে এ বিষয়টি পর্যবেক্ষণে নিতে হবে সবাইকে।’
আমদানির নামে অর্থপাচার হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণে আনার দাবি করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, চলতি হিসাবের এ ঘাটতির পরিমাণ এখনও উদ্বেগজনক স্থানে পৌঁছায়নি। কিন্তু যাচাই করে দেখা প্রয়োজন ঠিক কোন কোন কারণে ঘাটতির পরিমাণগুলো অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির হার অনেক বেড়েছে। মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি বৃদ্ধি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষণ। বিনিয়োগের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়লে সেক্ষেত্রে চলতি হিসাবের ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই। যদি কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে কেউ মূলধনি যন্ত্রপাতির নামে অন্য পণ্য আনে, কিংবা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার করে, তাহলে তা অর্থনীতির জন্য শঙ্কার বিষয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-আগস্ট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আনতে নতুন এলসি খোলা হয়েছে ৮৭ কোটি ডলারের, স্থানীয় মুদ্রায় যা সাত হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। এটি গত বছরের আলোচিত সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আনতে নতুন এলসি খোলা হয়েছে ৭৮ কোটি ডলারের, স্থানীয় মুদ্রায় যা ছয় হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা।
একইভাবে বেড়েছে এলসি নিষ্পত্তি, অর্থাৎ পণ্য খালাসের পরিমাণ। গত জুলাই-আগস্ট মাসে এলসি নিষ্পত্তি হয় ৬৩ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের, গত বছরের আলোচিত সময়ে যা ছিল ৫৭ কোটি ৫২ লাখ ডলারের।
আবার তথ্য বলছে, ইন্টারমেডিয়েট গুডস ও বা শিল্পের উপকরণ মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি চাহিদা বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। নিষ্পত্তি বেড়েছে ৭৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। অথচ গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল তিন দশমিক ৯১ শতাংশ। এভাবে বেড়েছে শিল্পের অন্যান্য পণ্যের চাহিদাও।