নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর দিয়ে মোট আমদানির প্রায় ৮০ শতাংশ পণ্য কনটেইনারবাহী হয়ে আসে। আর রপ্তানির প্রায় শতভাগ পণ্য এ পদ্ধতিতে পরিবাহিত হয়। কিন্তু ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ১৫ দফা দাবিতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ডিপো ও ডিপো থেকে বন্দরগামী কনটেইনারবাহী পণ্য প্রাইম মুভার (ট্রেইলার), কাভার্ডভ্যান ও ট্রাকসহ পণ্যবাহী একটি গাড়িও চলাচল করেনি। এতে হাজার কোটি টাকার পণ্য আটকে পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, শিপিং এজেন্টসহ বন্দর ব্যবহারকারীরা।
বাংলাদেশ কাভার্ডভ্যান-ট্রাক-প্রাইম মুভার পণ্য পরিবহন মালিক অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের অগ্রিম আয়কর বাতিল, নেয়া অগ্রিম আয়কর ফেরত, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানচালকদের লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রয়েছে, অবিলম্বে লাইসেন্স দেয়া চালু করা, ভারী লাইন্সেস দেয়া, টার্মিনাল নির্মাণ, বন্দরের প্রবেশে স্থায়ী বায়োমেট্রিক কার্ড দেয়া, বন্দরের অভ্যন্তরণে লোড ও আনলোডের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা বাড়ানো, বন্দর জেটির আয়তন অনুসারে আনুপাতিক হারে বাড়ানো ও অবকাঠামোগত সক্ষমতা বাড়ানো, সড়কে যতত্রত তলাশির নামে হয়রানি বন্ধ করা, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ, লকডাউনে প্রণোদনা দেয়া, সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা ও ফোরামের মিটিং প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দাবিতে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ১৫ দফা দাবিতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ডিপো ও ডিপো থেকে বন্দরগামী কনটেইনারবাহী পণ্য প্রাইম মুভার (ট্রেইলার), কাভার্ডভ্যান ও ট্রাকসহ পণ্য পরিবহন অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি গত ২৪ ঘণ্টায় কনটেইনারবাহী একটি গাড়িও চলাচল করেনি।
অন্যদিকে বন্দর কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, পরিবহন শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করায় গতকাল সকাল ৬টা থেকে পণ্যবাহী গাড়ি ঢুকতে পারেনি বন্দরে। ফলে বন্দরের এনসিটি, সিসিটি ও জিসিবির জেটি ও ইয়ার্ডে লোড-আনলোডে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। এক পর্যায়ে জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানো বন্ধ হয়ে যায়। অথচ স্বাভাবিক সময়ে আমদানি ও রপ্তানিবাহী প্রায় আট হাজার কনটেইনার পরিবহন বন্দর থেকে ডিপো ও ডিপো থেকে বন্দরের পরিবহন হতো। গতকাল সকাল পর্যন্ত বন্দর ইয়ার্ডে মোট কনটেইনার ছিল প্রায় ৩৮ হাজার। অন্যদিকে বন্দরের জলসীমানায় থাকায় ৭৮টি জাহাজের মধ্যে ৫৩টি জাহাজ থেকে পণ্য খালাস কার্যক্রম চলছিল এবং ২৫টি থেকে পণ্য খালাস কার্যক্রম শুরু হয়নি।
হাজার কোটি টাকার পণ্য আটকে পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, শিপিং এজেন্টসহ বন্দর ব্যবহারকারীরা। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী একাধিক আমদানি ও রপ্তানিকারক বলেন, করোনার কারণে ব্যবসা ও বাণিজ্য অনেকটা স্থবির। করোনার আগের মতো গতিশীল হতে কয়েক বছর সময় লাগবে। আর বৈশ্বিক মহামারি করোনার ধকল সামলানোর আগেই পরিবহন ধর্মঘটে বন্দরে অচলাবস্থা সৃষ্টি মানে দেশের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী। এমনিতে সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, চীনসহ অনেক বন্দরে যেখানে জাহাজজটে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে চট্টগ্রাম বন্দর কিছুটা স্বস্তিতে ছিল। এ ধরনের ধর্মঘটের কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানির লিড টাইম, বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থান ইত্যাদিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, যার ফলাফল সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করবে।
গতকাল বিকাল ৫টায় চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. মাইনুদ্দিন বলেন, ‘ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ ১৫ দফা দাবিতে ৭২ ঘণ্টা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। আমরা তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে পরিবহন বন্ধ রেখেছি। আর পরিবহন শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করায় গতকাল সকাল ৬টা থেকে পণ্যবাহী গাড়ি যায়নি বন্দরে। এমনকি একটি কনটেইনারও পরিবহন হয়নি। ফলে বন্দরের এনসিটি, সিসিটি ও জিসিবির জেটি ও ইয়ার্ড এবং বেসরকারি ডিপোগুলোর লোড-আনলোডে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের বিভিন্ন দাবি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে জানিয়েছি। কিন্তু দাবি মানার ব্যাপারে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সংস্থা দাবি পূরণে আলোচনা করেনি। তাই আমরা ৭২ ঘণ্টা আন্দোলন চালিয়ে যাব। আর এ সময়ে দাবি না মানলে আরও কঠোর কর্মসূচি নিয়ে আবার আন্দোলন করা হবে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, ‘ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ১৫ দফা দাবিতে অচলবস্থা সৃষ্টি হয়েছে কনটেইনার পরিবহনে। ফলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিপো থেকে বন্দর এবং বন্দর থেকে ডিপোগামী একটি কনটেইনার পরিবহন হয়নি। আর এ আন্দোলন যদি ৭২ ঘণ্টা চলে তাহলে আমাদের পরিচলন লোকসান হবে প্রায় তিন কোটি টাকা। আর তিনদিন কনটেইনার পরিবহন না হলে যে জট সৃষ্টি হবে, তা ১৫ দিন লাগবে ক্লিয়ার হতে। এতে আমদানি ও রপ্তানিকারদের ওপর চাপ বাড়বে। দিন শেষে চূড়ান্ত দায় ভোক্তারা বহন করবে।’
বন্দর পরিচলন কার্যক্রমের প্রভাব সম্পর্কে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, আন্দোলনের প্রভাবে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বেসরকারি ডিপোগুলোতে এবং ডিপো থেকে বন্দর ইয়ার্ডে কোনো কনটেইনার পরিবহন হয়নি। তবে সরাসরি যে কারখানার ট্রাক ও লরি আছে তারা কিছু কনটেইনার পরিবহন করেছে। বিশেষ করে সিমেন্ট ও স্ক্র্যাব আমদানিকারকরা। আর কনটেইনার পরিবহন বন্ধ থাকায় অনেকটা জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানোও এক সময়ে বন্ধ হয়ে যায়। এ ধরনের আন্দোলন অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।