সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট অব অরজিনের (উদ্যোক্তা সনদ) ডিজিটাল স্বাক্ষর কপি গ্রহণ করছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর পরিবর্তে প্রত্যেক আমদানিকারককে আমদানির বিপরীতে শুল্ক ছাড় পাওয়া মূল্যের সমপরিমাণ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি করতে হচ্ছে। যদিও এটি এনবিআরের মৌখিক নির্দেশনা। তবে বিকল্প না থাকায় আমদানিকারকরা অনেকটা নিরুপায় হয়ে ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে পণ্য ছাড়করণ করছে।
এতে পণ্যপ্রতি আমদানিকারকদের ব্যয় বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে। যদিও করোনার প্রভাবে বাজারের মন্দাভাব চলছে। এতে সময়মতো পণ্য বিক্রি করতে না পারলে বিপুল পরিমাণে লোকসান হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
আমদানিকারক সূত্রে জানা যায়, চলমান করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমানে বিভিন্ন অফিস-আদালতের কার্যক্রম চলছে সীমিত আকারে ও অনলাইনে। সে কারণে ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ৭ এপ্রিল একটি চিঠি দিয়ে সে দেশ থেকে ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট অব অরজিনে ডিজিটাল স্বাক্ষরযুক্ত অথবা স্বাক্ষরবিহীন ইলেকট্রিক্যালি গ্রহণ করতে অনুরোধ জানায়। ৩০ জুন পর্যন্ত এভাবে কার্যক্রম চালাতে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। সেই চিঠির আলোকে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২৭ এপ্রিল এক চিঠিতে বিষয়টি এনবিআরকে জানায়। এই চিঠির আলোকে ৩০ জুনের মধ্যে ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট অব অরজিনের মাধ্যমে পণ্য চালান খালাস হচ্ছিল। তারপর পরিস্থিতি বিবেচনায় উভয় দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনলাইনে ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট অব অরজিন কাস্টমস কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা এনবিআরকে নির্দেশনা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যদিও এ প্রক্রিয়ায় জটিলতা রয়ে যায়।
প্রথম দিকে কাস্টম হাউসগুলো অরিজিলান হার্ডকপি ছাড়া পণ্য ছাড়করণে অনাগ্রহী ছিল। এতে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা পণ্য খালাসে মারাত্মক বেকায়দায় পড়েছিল। ফলে ভারত থেকে আমদানিকৃত বেশ কিছু পণ্য দেশের বিভিন্ন বন্দরে আটকে আছে। আর এখন প্রত্যেক আমদানিকারককে আমদানির বিপরীতে ছাড় পাওয়া মূল্যের সমপরিমাণ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি করতে হচ্ছে। তবে বিকল্প না থাকায় আমদানিকারকরা অনেকটা নিরুপায় হয়ে ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে পণ্য ছাড়করণ করছে।
সূত্রমতে, সাফটা সুবিধার আওতায় আমদানি করা পণ্য ছাড়করণে বিপাকে পড়েছে দেশের ইস্পাত খাতের শীর্ষ কোম্পানি বিএসআরএম। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত এক চিঠির মাধ্যমে এনবিআরকে জানান, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে ভারত
সার্টিফিকেট অব অরজিনের হার্ডকপি ইস্যু করছে না। এর পরিবর্তে অনলাইন সনদ ইস্যু করছে, যা বাংলাদেশের কাস্টম হাউগুলো গ্রহণ করছে না। এর পরিবর্তে ছাড়কৃত মূল্যের সমপরিমাণ ব্যাংক গ্যারান্টি নিচ্ছে। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি আসলে হার্ডকপি এখন ইস্যু হবে না। আর ইস্যু না হলে আমাদের জমাকৃত ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত পাব না। অতএব ব্যাংক গ্যারান্টির পরিবর্তে আমদানিকারকদের কাছ থেকে আন্ডারটেকিং নিতে পারে, যা শুধু করোনাকালের জন্য প্রয়োজ্য হবে। বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষকে অনুরোধ করছি।’
খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজারের মসলাজাতীয় পণ্যের আমদানিকারক অসীম কুমার দাশ বলেন, ‘করোনা মহামারির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো নয়। এর মধ্যে সাফটা চুক্তির আওতায় আনা পণ্য সময়মতো খালাস নিতে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এখন আবার নতুন করে অলিখিতভাবে নিয়ম চালু করল আমদানিকৃত পণ্যের বিপরীতে ছাড়কৃত মূল্য ডিপোজিট করা, যা আমাদের পক্ষে অনেক কষ্টকর। এতে একদিকে চলতি মূলধন আটকে যাচ্ছে, অন্যদিকে ব্যবসায়িক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। কয়েক মাস আগেও খালাস করতে না পারায় আমদানি পণ্য বন্দরে দিনের পর দিন পড়েছিল। তখন আমাদের লোকসান গুনতে হয়েছিল। এ দায় কে নেবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘সাফটার আওতায় পণ্য আমদানিতে বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো যে দেশ থেকে পণ্য আসবে, সে দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরযুক্ত মূল কপি আমদানিকারককে নিজ নিজ কাস্টম হাউসে অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে। সেইসঙ্গে এনবিআরের অনলাইনেও একটি স্বাক্ষরযুক্ত কপি পাঠাতে হবে। এতদিন এভাবে পণ্য চালান খালাস হচ্ছিল কাস্টম হাউস থেকে। এখন আবার সাফটা সুবিধার আওতায় আনা পণ্যেও ছাড়প্রাপ্ত টাকা ব্যাংক ডিপোজিট করে রাখতে হচ্ছে। সনদের কপি জমা দিলে তখন ডিপোজিট ফেরত দেবে। আমাদের এক কনটেইনার পণ্যের জন্য প্রায় ১১ লাখ টাকা করে ব্যাংক ডিপোজিট করতে হচ্ছে। এতে তো আমাদের চলতি মূলধন আটকে যাচ্ছে, যা আমাদের ব্যবসায় প্রভাব ফেলছে। আবার আমদানিকৃত পণ্যের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে। যেহেতু আমার একটা চলতি মূলধন বিনিয়োগ হচ্ছে। এটারও একটা কস্ট আছে। তার চেয়ে সাফটা অনলাইন সনদ চেক করে ছাড়করণে সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। আর অনলাইন সনদ তো নকল হয় না।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সাফটার চুক্তির আওতায় আনা পণ্য খালাসে ব্যাংক ডিপোজিট করার নিয়ম চালু করায় আমদানিকারকদের ব্যয় বাড়ছে। কারণ এ টাকার একটা তো কস্ট আছে। আর সনদ আসলে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে, এটা কিন্তু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এমনিতে করোনার জন্য বাজারের মন্দাভাব চলছে। এসব কারণ বিবেচনা করে ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য জটিলতা পরিহার করা উচিত। এতে দেশের মানুষ লাভবান হবে। এ বিষয়ে আমরা এনবিআরকে একটি চিঠি দিয়েছি। আশা করছি তারা বিষয়টি সদয় বিবেচনা করবে।’