আমদানি-রফতানি বাধা পায় নানা কৌশলে

তামাক ও অ্যালকোহল ছাড়া সব ধরনের বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে ভারত। ফলে ভারতে পণ্য রফতানিতে শুল্কসংক্রান্ত কোনো বাধা নেই। কিন্তু বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রায়ই বলেন পণ্য রফতানিতে নানা বাধার কথা। এগুলো হলো ‘নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার’ বা অশুল্ক বাধা। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যের অশুল্ক বাধার বিষয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব আজ

মাসুম বিল্লাহ জাকারিয়া পলাশ: ভারতের বাজারে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। এ খবরে আশাবাদী হয়ে কিছু প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য ভারতে পাঠাচ্ছিলেন বাংলাদেশি উদ্যোক্তা রফিকুজ্জামান। ভারতীয় আমদানিকারকের সঙ্গে এ নিয়ে তার যোগাযোগও হয়। কিন্তু এ পণ্য কাস্টমস অতিক্রম করতে বিলম্ব হবে, তা ভাবনায় ছিল না তার। কুমিল্লার আখাউড়া সীমান্ত থেকে ত্রিপুরায় পাঠাতে চেয়েছিলেন পণ্যগুলো। আগরতলায় ভারতীয় শুল্কস্টেশন গিয়ে পণ্যগুলো আটকে গেল।

জানা গেছে, সেখানে একজন সুপারিনটেনডেন্ট কর্মরত ছিলেন, যার পণ্য খালাসের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে সই দেওয়ার ক্ষমতা নেই। পার্শ্ববর্তী স্টেশন থেকে সহকারী কমিশনার পদের কর্মকর্তা আসতে অপেক্ষা করতে হয় আরও সাত দিন। এতে পণ্যটি ভারতের বাজারে পৌঁছাতে বিলম্ব হয়। আর গ্রাহকের হাতে পৌঁছানোর আগেই হয়ে যায় মেয়াদোত্তীর্ণ। এমন অনাকাক্সিক্ষত বিলম্বের মুখোমুখি হয়ে ওই উদ্যোক্তা ভারতে রফতানির প্রতি আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছেন।

আবার ভারত থেকে বিস্কুট কোম্পানির মেশিনারি আমদানি করেন এক উদ্যোক্তা। তিনি জানান, প্রয়োজনীয় মেশিনারি বেনাপোল সীমান্ত থেকে আমদানির সুযোগ নেই, কিন্তু সমুদ্রপথে আমদানি করা যায়। একই সমস্যা রয়েছে কোনো পণ্য ভারতে যাওয়ার ক্ষেত্রেও। জানা গেছে, কখনও পদস্থ কর্মকর্তার অনুপস্থিতি, কখনও একেক বন্দরে একেক নিয়মের অজুহাতে ব্যাহত হয় বৈধপথের আমদানি-রফতানি। এছাড়া একই সীমান্তের দুই প্রান্তে দুই দেশের আলাদা কাস্টম অফিস রয়েছে। কিন্তু তাদের ব্যবহৃত প্রযুক্তি ও ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই অনেক ক্ষেত্রেই। সাপ্তাহিক ছুটির ভিন্নতাও বড় বাধা বলে মনে করছেন বণিকরা। বাংলাদেশে শুক্রবার, আর ভারতের কাস্টম অফিসগুলোতে সাপ্তাহিক ছুটি থাকে রোববার। এ কারণেও ব্যাহত হয় দুই দেশের বাণিজ্য।

বাণিজ্যের এসব প্রতিবন্ধকতা নিরসনে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলছে বছরের পর বছর। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন নিয়ে অগ্রগতি সামান্যই। প্রতিবছরই দ্বিপক্ষীয় সভায় এ নিয়ে পরামর্শ বিনিময় হয়। কিন্তু বাস্তবে সমস্যা চলছেই।

এ বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (আইবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও পরিচালক মোহাম্মদ আলী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অশুল্ক বাধার যে কত প্রকার রয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। কাস্টমস ও অন্যান্য কর্মকর্তারা চাইলে ব্যবসায় বাধা সৃষ্টির নানা উপায় বের করতে পারেন। এ নিয়ে আমরা বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানাই। সরকার ভারতীয় পক্ষকে ক‚টনৈতিক চ্যানেলে বলে। বাস্তবে আমরা ব্যবসায়ীরাই ভুগছি। তবে পণ্যবিশেষে আমদানির পরিস্থিতি আগের চেয়ে সুবিধাজনক হয়েছে বলেও তিনি মত দেন।’

সূত্রমতে, ছুটির দিনের ভিন্নতা সমন্বয় করতে ডাউকি-তামাবিল সীমান্তে পরীক্ষামূলকভাবে একটি উদ্যোগ নিতে একমত হয়েছিল দুই দেশ। দুটি কাস্টমসেই যৌথভাবে বছরের ছয় মাস শুক্রবার আর ছয় মাস রোববার ছুটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু দেখা যায়, ডাউকির ভারতীয় স্থানীয় কাস্টমস স্টেশনে রোববারে কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকেন না। এ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে জানানো হয় ২০১৫ সালে। জয়েন্ট গ্রæপ অব কাস্টমসের (জেজিসি) দশম সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু ভারতীয় পক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করে বলে, রোববার দায়িত্ব পালনের জন্য কর্মকর্তাদের সেখানে নিযুক্ত করা হয়েছে। পরে গত আগস্টে শেষ হওয়া জেজিসির ১১তম সভায় এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।

তবে ওই সভায় দুই পক্ষের মধ্যে উপযুক্ত কর্মকর্তাদের কাস্টমস স্টেশনে নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা হয়। সূত্রমতে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়, আগের সভায় দুই পক্ষ একমত হয়েছিল যে বাণিজ্য বেশি হয় এমন ১৬টি কাস্টমস স্টেশনে সহকারী কমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই তারা এটি করবে বলে কথা ছিল। কিন্তু ভারতীয় পক্ষ তা বাস্তবায়ন করেনি। এতে ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে ভারতীয় পক্ষ দাবি করেছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলোয় সুপারিনটেনডেন্ট পদের কর্মীরা দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তাদের আমদানি ও রফতানি করা পণ্যের নথিপত্র যাচাই ও অনুমোদন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সহকারী কমিশনারের অনুপস্থিতির কারণে কখনোই পণ্য আমদানি-রফতানিতে সমস্যা ছিল না বলে ভারত দাবি করে। বাংলাদেশের কাস্টমস কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের হিলি, রানাঘাট, চেংরাবান্দা, ফুলবাড়ী এবং মাদিপুর কাস্টমসে কোনো বিলম্ব দেখা যায় না। কিন্তু বাকি বন্দরগুলোয় এ সমস্যা বিদ্যমান।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত নবম জেজিসির আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দুই শতাধিক শুল্কস্টেশনের মধ্যে ৩০টির মতো স্টেশনকে চিহ্নিত করা হয়। তার মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে ১৬টি লোকাল কাস্টমস (এলসি) স্টেশন নির্ধারণ করে তাতে বেশ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান, কাস্টমস কর্মকর্তাদের সীমান্তে আসা-যাওয়া, কার-পাস সিস্টেমসহ বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়েছে। এছাড়া প্রতিবছর জেজিসির যৌথ সভায় দুই দেশের বাণিজ্যসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়ে আসছে। কিন্তু এসব আলোচনার মাধ্যমে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা অনুযোগ মিলছে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও সম্প্রতি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধাগুলো বড় সমস্যা সৃষ্টি করছে।

 

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০