রহমত রহমান: দেশে শব্দদূষণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে, বিশেষ করে মোটরসাইকেলের হর্নের বিকট শব্দ। মোটরসাইকেলে ব্যবহার করা হচ্ছে শব্দদূষণকারী ‘ইলেকট্রিক হর্ন’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গাড়ির যন্ত্রাংশ ঘোষণায় এসব হর্ন আমদানি হচ্ছে। স্থানীয় মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি আমদানি করছে এসব হর্ন। শব্দদূষণকারী হলেও আইনের ‘অস্পষ্টতার’ সুযোগ নিচ্ছে আমদানিকারকরা। আর আমদানিনীতি আদেশ থাকায় আইনের দুর্বলতা সত্ত্বেও এসব হর্ন খালাস করতে বাধ্য হচ্ছে কাস্টম হাউস। খালাস হলেও পরিবেশ দূষণকারী এসব ইলেকট্রনিক হর্নের বিষয়ে এনবিআরের দিকনির্দেশনা চেয়ে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। যন্ত্রাংশ ঘোষণায় কীভাবে ইলেকট্রিক হর্ন আমদানি হয়, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা।
স্থানীয় মোটরসাইকেল উৎপাদনকারীদের দেয়া তথ্যে দেখা গেছে, দেশে ২০১৫ সালে এক লাখ ৮০ হাজার মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছিল। ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৮৭ হাজার, ২০১৮ সালে বিক্রি হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ। আর ২০২৩ সালের মধ্যে মোটরসাইকেলের বাজার বছরে ১০ লাখে উন্নীত হবে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে কয়েকটি কোম্পানি মোটরসাইকেল রপ্তানি করছে। দেশে বর্তমানে ছয়টি কোম্পানি মোটরসাইকেল উৎপাদন করছে। এর মধ্যে রয়েছে রানার অটোমোবাইলস লিমিটেড, ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মার্সেল বিডি লিমিটেড, রোডমাস্টার মোটরস, নিউ গ্রামীণ মোটরস এবং এইচপিএম অটো ইন্ডাস্ট্রি।
সূত্রমতে, মানুষের স্বাভাবিক শব্দ গ্রহণের মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল (ডিবি) পর্যন্ত। আর ৬০ ডিবির বেশি শব্দ মানুষের সাময়িক এবং ১০০ ডিবির বেশি শব্দ সম্পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি করতে পারে। তবে যানবাহনে ব্যবহƒত কিছু হর্ন রয়েছে, যেগুলো ৬০ ডিবি থেকে ১২০ ডিবি পর্যন্ত শব্দ উৎপন্ন করতে পারে। তাই ৭৫ ডিবির ওপরে হর্ন আমদানি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। তবে বাজারে চাহিদা থাকায় কিছু অর্থলোভী আমদানিকারক হামেশাই মিথ্যা ঘোষণায় উচ্চ শব্দের হর্ন আমদানি করছেন। সম্প্রতি রাজধানীর নিউ ইস্কাটন রোডের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘মীম অটোস’ জাপানের টয়োটা করপোরেশন থেকে এমন হর্ন আমদানি করে, যার শব্দের মাত্রা ১০৮ ও ১১০ ডেসিবল। কিন্তু ৭৫ ডেসিবলের ওপরে হর্ন আমদানি নিষিদ্ধ থাকায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস এসব হর্ন জব্দ করে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস হামেশাই হর্নের এমন চালান জব্দ করে।
বহু আমদানিকারক, এমনকি স্থানীয় স্থানীয়ভাবে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যন্ত্রাংশ ঘোষণায় ইলেকট্রিক হর্ন আমদানি করছে। বেশিরভাগ হর্নের শব্দমাত্রা ৮০ ডেসিবলের ওপরে। আইনের অস্পষ্টতা আর আমদানিনীতি আদেশের কারণে এসব হর্ন খালাসে অনুমোদন দেয় কাস্টম হাউস।
তবে আমদানি করা মোটরসাইকেল ও গাড়ির হর্নের বিষয়ে দ্রুত শুল্কায়নের বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে এনবিআরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়, বিভিন্ন দেশ থেকে স্থানীয় মোটরসাইকেল প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন আমদানিকারক ‘ভিহিকল পার্টস’ বা গাড়ির যন্ত্রাংশ ঘোষণায় ইলেকট্রিক হর্ন আমদানি করে আসছে। এসব ইলেকট্রিক হর্নের গায়ে অনেক সময় শব্দের মানমাত্রা (ডিবি) উল্লেখ থাকে, আবার অনেক সময় উল্লেখ থাকে না। আমদানি করা পণ্য চালান আমদানি নীতি আদেশের শর্তাবলি মেনে শুল্কায়ন ও খালাস করা হয়। তবে আমদানি নীতি আদেশ, ২০১৫-১৮-এর আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় দেখা গেছে, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ‘৭৫ ডেসিবল’ মাত্রার হর্ন আমদানি নিষিদ্ধ। বিধিমালায় বলা হয়েছে, ‘হর্ণ অর্থ উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী নিউম্যাটিক, হাইড্রোলিক বা মাল্টি টিউনড হর্ন’। অর্থাৎ সংজ্ঞায় নিউম্যাটিক, হাইড্রোলিক ও মাল্টি টিউনড হর্নকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু ইলেকট্রিক হর্নকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
আবার বিধিমালার অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কোনো ব্যক্তি মোটর, নৌ বা অন্য কোন যানে অনুমোদিত শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী হর্ন ব্যবহার করতে পারবে না।’ বিধিমালায় এলাকা বেঁধে শব্দের মানমাত্রা দেয়া আছে। যাতে বলা হয়েছে, নীরব এলাকায় দিনে শব্দের মানমাত্রা ৫০ ও রাতে ৪০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ও রাতে ৪৫ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ও রাতে ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডেসিবল শব্দ করা যাবে। অর্থাৎ একটি গাড়ি সব এলাকায় শব্দের এসব মানমাত্রা মেনে যেকোনো সময় যেতে পারবে। গাড়ির হর্নের ক্ষেত্রে অনুমোদিত শব্দমাত্রা কত, তা স্পষ্ট করা হয়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চিঠি অনুযায়ী, অনুমোদিত শব্দমাত্রা ৮৫ ডেসিবল। আমদানি নীতি ও শব্দদূষণ বিধিমালায় শব্দমাত্রা কত হবে সে বিষয়ে পরস্পর সাংঘর্ষিক নির্দেশনা রয়েছে। ফলে ইলেকট্রিক হর্ন শুল্কায়নের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে বুয়েট ও চুয়েটে এসব হর্ন পরীক্ষা করা হয়েছে, যাতে দেখা গেছে, হর্নের মোড়কে শব্দমাত্রা ১১০ ও ১১১ ডেসিবল উল্লেখ থাকলেও ৮৫ ডেসিবলের নিচে শব্দমাত্রা পাওয়া গেছে। কাস্টমসের চিঠিতে বলা হয়, স্থানীয় মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী ও বিভিন্ন আমদানিকারক এসব হর্ন আমদানি করছে। উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে বলে এনবিআরের নির্দেশে হর্নের চালানগুলো এরই মধ্যে খালাস দেয়া হয়েছে। তবে শব্দের মানমাত্রার বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের এক সদস্য শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, এনবিআর আমদানি প্রতিরোধ করতে পারবে না, শুধু আইন প্রতিপালন করতে পারবে। আইনের যে যে জায়গায় অস্পষ্টতা রয়েছে, তা দূর করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হবে।
এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘শব্দদূষণ কমাতে হলে পুরো সিস্টেমে হাত দিতে হবে। দেশে কিছু হর্ন উৎপাদন হয়, বাকিগুলো আমদানি হয়। দূষণ কমাতে হলে আমদানি ও উৎপাদন নিষিদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে সবাইকে কাজ করতে হবে। মোটরসাইকেল ও গাড়ি রেজিস্ট্রেশন, রুট পারমিট দেয়ার সময় হর্নের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে বিআরটিএ। আর পুলিশ রাস্তায় গাড়িতে হর্ন পেলেই ব্যবস্থা নেবে। সরকারকেও কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে শব্দদূষণ কমতে পারে।’ y