নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে ডলার সংকটের কারণে আমদানি নিয়ন্ত্রণে গত বছর সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এর প্রভাবে বিদায়ী অর্থবছর আমদানি কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। তবে রপ্তানি কিছুটা বাড়ে এ সময়। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি বিদায়ী অর্থবছরে ৪৮ শতাংশ কমেছে।
যদিও বহির্বিশ্বের সঙ্গে দেশের সামগ্রিক লেনদেন বড় ঘাটতিতে পড়েছে। আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি হওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
খাতসংশ্লিষ্ট কয়েকজন বলেন, ডলারের বাজার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে খারাপ বার্তা গেছে। এর ফলে ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে অনেক ব্যাংক। আবার রপ্তানি আয় আসার গতিও কমে গেছে। প্রবাসী আয়ও বেশি দাম দিয়ে দেশে আনা যাচ্ছে না। ফলে বৈদেশিক মুদ্রায় আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশি। এতেই আর্থিক হিসাবে দেখা দিয়েছে বড় ঘাটতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছর ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ৮২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে গত অর্থবছর আমদানি কমেছে ১৩ বিলিয়ন ডলার বা ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এছাড়া বিদায়ী অর্থবছরে এলসি খোলা কমার কারণে আমদানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত অর্থবছর ২৬ দশমিক ৪২ শতাংশ এলসি খোলা কমেছে। একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশ।
অন্যদিকে গত অর্থবছর পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৫২ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে তিন দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার বা ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৯ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল।
এতে করে বিদায়ী অর্থবছর বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। তার আগের অর্থবছর এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছর বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ১৬ দশমিক ১০ বিলিয়ন বা ৪৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর সব মিলিয়ে চলতি হিসাবের ঘাটতি আগের বছরের ১৮ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসাব পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বাণিজ্যিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে নেয়া বিদেশি ঋণ ব্যাপক কমেছে, যে কারণে আর্থিক হিসাবে ধারাবাহিক উদ্বৃত্ত থেকে বড় অঙ্কের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। গত অর্থবছর শেষে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার, যা গত এক যুগের মধ্যে প্রথম ও ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘাটতি। এর আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। তখন ঘাটতি ছিল ৬৩ কোটি ডলার। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ১৫ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
আর্থিক হিসাবে ঘাটতির প্রভাবে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি হয়েছে ৮ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। তার আগের অর্থবছরের ঘাটতি ছিল ৬ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।
সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বৃদ্ধি মানে বিভিন্ন উৎসে দেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, পরিশোধ হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। তার আগের অর্থবছরে বিক্রি করে আরও ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। এভাবে ডলার বিক্রির কারণে ধারাবাহিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছর ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগের বছর পাঠিয়েছিলেন ২১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছর প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
এদিকে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বিদায়ী অর্থবছর সামান্য কমছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ যেখানে ৪ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই পেয়েছিল, গত অর্থবছরে তা কমে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়।
একই সঙ্গে আলোচ্য সময়ে দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) নেতিবাচক অবস্থা অব্যাহত আছে। গত অর্থবছরে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (নিট) যা এসেছিল, তার চেয়ে এক কোটি ৮০ লাখ ডলার বেশি চলে গেছে। তার আগের অর্থবছরের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল (ঋণাত্মক) ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার।