Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 4:16 pm

আমরা কখনও আশা ছাড়ি না

ইমদাদ ইসলাম: ‘উই নেভার লুজ হোপ’। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (পিআইসিইউ) প্রবেশদ্বারে লেখা এমন একটি বার্তা। এখানেই মাথায় গুলিবিদ্ধ মুস্তাফিজুর রহমান ও নিশামণি দম্পতির সাত বছরের একমাত্র সন্তান বাসিত খান মুসাকে নিয়ে ‘আশা না ছাড়ার’ লড়াই করছেন মা-বাবা আর চিকিৎসকেরা। একটা আশার সংবাদ শুনার অপেক্ষায় পুরো দেশবাসী। গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর রামপুরার মেরাদিয়া হাট এলাকার বাসার নিচে গুলিবিদ্ধ হয় মুসা ও তার দাদি মায়া ইসলাম (৬০)। দাদি মারা যান সঙ্গে সঙ্গেই। দেশ সর্বোচ্চ পর্যায়ের চিকিৎসা নিশ্চিত করা গেলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য মুসাকে সিঙ্গাপুরের মতো দেশে পাঠানো যাচ্ছে না অর্থ সংকটে। বাংলাদেশ কখনও হারে না। সব প্রতিবন্ধক পেরিয়ে বাসিত খান মুসা সুস্থ হয়ে ফিরবে মা-বাবা’র কোলে— এ প্রত্যাশা দেশবাসীর।

অনেক ত্যাগের বিনিময়ে সফল হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন। তাৎক্ষণিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব না হলেও ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে সবকিছুই। সবচেয়ে আশার কথা এ দেশের তরুণরা এখন দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। দেশে ভালো কিছু করতে চায়। স্বদেশের মাটিকে ভালোবেসে দেশের জন্য কিছু করতে চাওয়া তরুণদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। ইতোমধ্যে তরুণরা ট্রাফিক পরিচালনার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা দেখিয়েছে। তাদের সুযোগ দিলে তারা দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। তরুণদের নেতৃত্ব ও অভিজ্ঞদের প্রাজ্ঞ দিকনির্দেশনার আলোকে দেশটাকে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে পারলে তরুণদের স্বপ্নের দেশ হিসেবে নতুন বাংলাদেশকে গড়ে তোলা সম্ভব। বিগত সময়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাওয়া অনেক মেধাবী তরুণই এখন দেশে থাকতে চায়। তাই সংস্কারের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা অনুযায়ী আগামীর বাংলাদেশ গড়া এখন সময়ের দাবি। উন্নয়ন দেশের জন্য দরকার। কিন্তু সব উন্নয়ন দেশের জন্য সুফল বয়ে আনে না।

প্রধান উপদেষ্টা তাই যথার্থ বলেছেন আমাদের শুধু উন্নয়নের পেছনে ঘুরলে তো হবে না। আমাদের এটাকে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে ফেলতে হবে। এটা উন্নয়নের মহাসড়ক নয়, এটা সামাজিক সমঝোতার মহাসড়ক। এই সামাজিক সমঝোতা এবং আবহাওয়ার সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত হবে না। নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত একটা দেশ হবে। সামাজিক দিক থেকে উন্নত একটা দেশ হবে। পরিবর্তন হবে, সংস্কার হবে। বড় চিন্তার মধ্যে যেতে হবে। প্রথমত, চিন্তাটা ভিন্ন করতে হবে। অতীতের চিন্তা, অতীতের ক্রমধারায় করলে হবে না। সব কিছু দ্রুত করতে হবে। অতিতের স্বজনপ্রীতি আর অনিয়ম থেকে বের হয়ে সামনের দিকে চলতে হবে। ল’ অ্যান্ড অর্ডার ইস্টাবলিশ করতে হবে। সবাইকে স্বতঃস্ফূতভাবে আইনকে মানতে হবে। দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের মতের ভিন্নতা থাকতে পারে। এজন্য আমরা কেউ কারও শত্রু হব না। সবার মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এখানে রাষ্ট্র এবং ব্যক্তির উভয়ের দায়িত্ব রয়েছে।

বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেসব জায়গায় সংস্কার দরকার সেগুলো সম্পন্ন করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারে কমিশন গঠন করার ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্র ও সংস্থাপন সচিব সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের প্রধান হিসেবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে অধ্যাপক আলী রীয়াজকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে নতুন বাংলাদেশ গড়তে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের ২৫টি নির্দেশনা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। সেগুলো হলো— ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকারের সব পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে প্রধান উপদেষ্টার দেয়া ‘মার্চিং অর্ডার’ অনুসরণ করতে হবে। সৃষ্টিশীল, নাগরিকবান্ধব মানসিকতা নিয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগকে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার পরিকল্পনা এবং একইসঙ্গে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। সংস্কার কর্মসূচি প্রণয়নে প্রয়োজন অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা ও তাদের মতামত নিতে হবে। বিবেক ও ন্যায়বোধে উজ্জীবিত হয়ে সবাইকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সততা, নিষ্ঠা, জবাবদিহি নিশ্চিত করে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য গৎবাঁধা চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে, চিন্তার সংস্কার করে, সৃজনশীল উপায়ে জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে, সেবা সহজীকরণের মাধ্যমে জনগণের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। বাজেটের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি এবং সরকারি অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ক্রয়ে যথার্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিতে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আগ্রহ, ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, দেশের স্বার্থে তা সর্বোত্তম উপায়ে কাজে লাগাতে হবে। নিজ কর্তব্যকর্মে দায়িত্ববোধ ও সংবেদনশীলতা বজায় রাখতে হবে। সেবা-প্রার্থীদের কেউ যেন কোনোরূপ ভোগান্তি, হয়রানি কিংবা কোনো কারণে দীর্ঘসূত্রতার শিকার না হন তা নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যক্রম নিতে হবে। জরুরি সরবরাহ নিশ্চিত করে তা অব্যাহত রাখতে হবে। কৃষি উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সরকারকে জনবান্ধব সরকারে পরিণত করতে সমবেতভাবে কাজ করতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম যাচাই করে প্রয়োজনে সংস্কার করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও সঞ্চালন যাতে ব্যাহত না হয় সে বিষয়ে তৎপর থাকতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। গ্যাসের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্য সংগ্রহ, মজুত ও সরবরাহ সন্তোষজনক রাখতে হবে। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমদানির বিকল্প উৎস বের করতে হবে। ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়মিত তদারকি করতে হবে। শিল্প উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।

জাতি হিসেবে আমরা কখনও আশা ছাড়িনি। আশাই জীবন। আশাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। নতুন প্রজন্ম আমাদের সামনে এক নতুন বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আগ্রহ, ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, দেশের স্বার্থে তা সর্বোত্তম উপায়ে কাজে লাগাতে হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য গৎবাঁধা চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে, চিন্তার সংস্কার করে, সৃজনশীল উপায়ে জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। বিবেক ও ন্যায়বোধে উজ্জীবিত হয়ে সবাইকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সততা, নিষ্ঠা, জবাবদিহি নিশ্চিত করে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে।