আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতায় জিআই নিবন্ধন হচ্ছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক: সুন্দরবনের আয়তন ও মধু উৎপাদন সবই বাংলাদেশ অংশে বেশি থাকা সত্ত্বেও নিজেদের পণ্য হিসেবে মধুর আন্তর্জাতিক ভৌগোলিক নির্দেশক সনদ বা জিআই সনদ পায়নি বাংলাদেশ। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্বহীনতা বা উদাসীনতার কারণে ভারত এককভাবে হাতিয়ে নিয়েছে মধুর জিআই সনদ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এমন মন্তব্য করেছেন। রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে গতকাল ‘সুন্দরবনের মধু এখন ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য’ শীর্ষক ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন তিনি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিপিডির আরেক সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ও গবেষক নাইমা জাহান তৃষা।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভারতে যখন সুন্দরবনের মধুর জিআই সদন ঘোষণা হয়েছে তখন আমাদের সময় ছিল আপত্তি দেয়ার; কিন্তু আমরা সেটি করিনি। টাঙ্গাইল শাড়ির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। এটার দায়-দায়িত্ব কার? দেশে অনেক সমস্যা আছে, তাই এ সমস্যা স্থান পায়নি। এর আরও একটা কারণ আছে সেটা হলো, যারা মধু উৎপাদন করেন তারা দুর্বল। তাদের কণ্ঠও দুর্বল। তাই এগুলো স্থান পায় না। আমাদের প্রশাসনেও দক্ষ মানুষ খুবই কম। বিদেশে যারা বৃত্তি নিয়ে পড়ালেখা করছে তারা অধিকাংশই আমলা কর্মচারী। বাস্তবে এই শিক্ষা কতটুকু কাজে লাগছে?’

ভারতের এককভাবে মধুর জিআই সনদ নেয়া প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এটাকে নজরদারি করা হয় না। প্রশাসন বা আইন মন্ত্রণালয় কখনও এটা নিয়ে আলোচনা করেনি। তারা এসব বিষয় নিয়ে কখনও আলোচনা করেছেন কেউ বলতে পারবে না। তারা কখনও টাঙ্গাইল শাড়ি ও সুন্দরবনের মধু নিয়ে আলোচনা করেনি।’

তিনি আরও বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ও এটা নিয়ে উদ্যোগ নেয়নি। ব্যবসায়ী সমিতিও এটা নিয়ে আলোচনা করেনি। ব্যবসায়ীরা শুধু তুলেছে কালো টাকা সাদা করতে হবে, মধুর জিআই সনদ তাদের কাছে বড় সমস্যা নয়। জিআই সনদ না হলে পণ্যের বাণিজ্যিক দাম কীভাবে হবে? এটা অজানা, সবার ভূমিকা নিতে হবে যাতে মধুর জিআইটা সামিট লেভেলে নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

দেবপ্রিয় আরও বলেন, সুন্দরবনের মধুকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত দেয়ার জন্য ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক রেজিস্ট্রেশনের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলেন। দীর্ঘ সাত বছরেও সেটির রেজিস্ট্রেশন হয়নি। এই দায় আমরা কাকে দেব? অথচ ভারত আমাদের চার বছর পর ২০২১ সালে আবেদন করে জিআই স্বত্ব পেয়েছে। তিনি বলেন, দেশের পণ্যের ক্ষেত্রে কেন এমন হচ্ছে? এই অবহেলার দায়িত্ব কে নেবে?

অর্থনীতির জন্য মেধাস্বত্ব অধিকার (আইপিআর) সুরক্ষা ও এ-সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে এবং রপ্তানি সম্প্রসারণে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরিতে এটি ভূমিকা রাখে। বিশ্বের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব আইনকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।

তিনি জানান, গত ১৩-১৭ মে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায় এক কর্মশালায় সুন্দরবনের মধুকে ভারতের জিআই পণ্য হিসেবে তুলে ধরে টুইট করা হয়। এরপর বিষয়টি সিপিডির নজরে আসে। অথচ ভারতের চেয়ে বেশি পরিমাণ মধু বাংলাদেশে তৈরি হয়।

দেবপ্রিয় সতর্ক করে বলেন, মধুর বাজারে আগামীতে প্রতিযোগিতা কঠিন হবে। জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পরও বাজারে প্রতিযোগিতা করতে কষ্ট হবে। ভারতের বাজার অনেক বড়। তাদের উৎপাদন খরচও অনেক কম হয়। সার্ভে করে দেশের যেগুলো পণ্য আছে, তা জিআইয়ের অধীনে আনার জন্য অতিসত্বর কার্যক্রম হাতে নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশে মধু বেশি আহরণ হলেও হাতছাড়া হয়েছে জিআই সনদ। এ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডি মনে করে মেধাস্বত্ব বিষয়ের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে; যার মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের উপকারে আসে। জিআই সার্টিফিকেশন পেলাম কিন্তু পরবর্তী ফলোআপ করলাম না তা হলে এটার সুফল মিলবে না। ফলোআপ না করলে বাণিজ্যিক সম্ভাব্য ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে না।

তিনি বলেন, ‘সুন্দরবরে মধু নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে এটা সমাধান করতে হবে। কারণ এটা উভয় দেশেই আছে। ভারতের সঙ্গে জিআই ইস্যু নিয়ে সমঝোতা দরকার। এরকম নানা ধরনের সাংঘর্ষিক ইস্যু সামনে আসতে পারে। এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।’

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের মোট আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। তিন হাজার ৪৮৩ বর্গকিলোমিটার পড়েছে ভারতের ২৪ পরগনায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অংশে রয়েছে মোট আয়তনের ৬৬ ভাগ। এ বন থেকে প্রতি বছর মধু আহরণ হয় ৩০০ টন। ভারতে গত সাত বছরে গড়ে মধু সংগ্রহের পরিমাণ ১৫৭ টন। মধু আহরণ ও সুন্দরবনের অধিকাংশ জায়গা বাংলাদেশে থাকার পরও পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০