সাইফুর রহমান ফাহিম : ছাত্ররাজনীতি একটি বহুল পরিচিত যৌগিক শব্দ। যেখানে স্বাভাবিক অর্থে প্রথমে ছাত্রের ছাত্রত্বের পরিচয়, পরে ছাত্রের অধিকার সম্পর্কিত রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের একটি মাধ্যম এমনটিই মন-মস্তিষ্কে অঙ্কিত হয়। মূলত শিক্ষার্থীদের কল্যাণে, ন্যায্য অধিকার আদায়ে, বৈষম্য দূরকরণে এবং দেশের জাতীয় অধিকার আইন বাস্তবায়নের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে এদেশে উনিশ শতকের মূলের দিকে ছাত্ররাজনীতির গোড়াপত্তন হয়েছে। বঙ্গের পূর্বের ছাত্ররাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাছবিচার করে এক আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে এদেশের ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। এজন্য এর আলাপ-আলোচনা, ইতিহাস-ঐতিহ্য মহান ও বরাবরের মতোই গৌরবের। সেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের লড়াকু সৈনিক বেশে রাজপথে নেমে পড়ে মাতৃভাষার জন্য জীবন দেয়া, চুয়ান্নের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অধিকার নিয়ে এগিয়ে আসার সৎ সাহস, বাষট্টির নিন্দিত হামিদুরের শিক্ষাকমিশনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা, ছেষট্টির বঙ্গবন্ধুর ছয়দফায়, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশের ইতিহাসে সকল অধিকার আন্দোলনের প্রথম সারির অভিযাত্রী ছিল বাংলার তরুণ ছাত্ররাজনীতির সাথে লেগে থাকা একঝাঁক দেশপ্রেমিক। যাদের আদর্শ ছিল সকল কিছুর ঊর্ধ্বে দেশকে সকল অপশক্তি থেকে রক্ষা করা। এদেশের প্রাণপুরুষদের আদর্শই ছাত্ররাজনীতির মৌলিক মাপকাঠি। বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় পর্যায়ের নেতা এবং পূর্ববর্তীদের মেধা, শ্রম-ঘাম এমনকি ভবিষ্যৎ রূপরেখা দিয়ে দেশ এগিয়ে গেলেও ছাত্ররাজনীতি তাদের আদর্শের ওপর টিকে থেকে কতটুকু এগোতে পেরেছে তা হাল সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পৌঁছেছে। আর পূর্ববর্তীদের আদর্শনীতির সাথে বর্তমানদের নীতি কিংবা ক্রিয়াকলাপের বিষয়ে আলোচনায় বসলে ছাত্ররাজনীতি তুমুল সমালোচনার মুখেই পতিত হয়। হাল সময়ে ছাত্ররাজনীতি কতটুকু আদর্শের ওপর টিকে আছে তা পরিমাপ করার জন্য সে কালের ছাত্রআন্দোলনের সঙ্গে তুলনা না করলে বাছবিচার করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির বাস্তবায়ন হচ্ছে পেশা হিসেবে। একজন ছাত্রের মৌলিক কাজ শিক্ষা অর্জন করা, গবেষণা করা, শিক্ষার নতুন দ্বার উšে§াচন করা, উদ্ভাবনী কিছু করার প্রয়াস চালানো, পাশাপাশি কোনো প্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মাঠ পর্যায়ের আন্দোলনে নেমে পড়া। আর এমনটিই পূর্ববর্তীরা করেছেন। ভালো করলে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পূর্ববর্তীরা প্রথমত মেধাবী ভালো ছাত্র ছিলেন। দ্বিতীয়ত, সাহসী আন্দোলনকারী ছিলেন। এ সময়ের ছাত্রের প্রথম কাজই হলো ‘রাজনীতি’ নামক সিল সঙ্গেজুড়ে নিয়ে মেধাহীন হয়ে স্বাধীনভাবে দাপটের সাথে চোখ রাঙিয়ে চলাফেরা করা। সে জামানায় ছাত্ররাজনীতির যা সুফল হয়েছে এই জামানায় তার কুফলতা বৃদ্ধি পেয়ে পূর্বেরটা পুষিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ছাত্রদের নিজের দলের বা স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। উপর মহলের রথী-মহারথীদের বল-শক্তিতে ছাত্র হয়ে উঠে এক ক্ষমতাসম্পূর্ণ দ্বৈত্য-দানবে। যার পিছে শতাধিক কর্মী কোনো লক্ষ্যহীনভাবে কাজ করছে। যাদের কোনো মিশন নাই, কর্মসূচি নাই, নীতিমালা নাই। উদ্দেশ্য বাহুবল দেখিয়ে পার পাওয়ার একটি মাধ্যম এই রাজনীতি। তাই এ জোরজবরদস্তির অপরাজনীতি থেকে বাদ পড়ে যায় মেধাবীরা। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাত্ররাজনীতির মাঠ হয়ে উঠে মেধাশূন্য এক নরকে। শুধু কি তাই? একই দলের নানা গ্রুপিং তৈরি করে শিক্ষার পরিবেশে বিঘ্নতার ইতিহাস আছে ভূরি ভূরি। যেখানে ছাত্র বয়সে পেয়ে যাচ্ছে ক্ষমতা, টাকা ও বিশাল এক মেধাহীন কর্মীবাহিনী যাদের যা খুশি তাই করানো সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় শিক্ষার্থীর কাছে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতে হচ্ছে স্বয়ং শিক্ষাগুরু শিক্ষককে। এছাড়া অনেকেই অতিমাত্রায় বেপরোয়া হয়ে জড়িয়ে পড়ে মাদকাশক্তিতে। যার ফলে পরিবারও সন্তানের কাছে জিম্মি হতে হচ্ছে। আর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্ররাজনীতির পরিচয়ে চলছে নানাভাবে অপকর্ম, সিটবাণিজ্য,
চিনতাই-চাঁদাবাজি, মারামারি-হানাহানি এবং
ঘৃণ্যতম ধর্ষণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জরিপ করলে দেখা যায়, অধিকাংশই ছাত্রনেতা রাজনৈতিক বলয়ে অনেক দোকানে খাবার খেয়ে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। দোকানদার চাইলে মারধর করে। এমন অভিযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অলি আকন নামক এক দোকানি ৩৪ বছর দোকানদারি
করে মাথাভর্তি ঋণের বোঝা নিয়ে বাড়ি
ফিরেছেন শূন্যহাতে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বলতে গেলে, হলের সিট পাওয়ার জন্য কিংবা সিট টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনীতির নামে চলছে লেজুড়বৃত্তির প্রসারণ। আবার কিছু ছাত্র নিজ ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য রাজনীতির সাইনবোর্ডে নবীন ছাত্রদের ব্যবহার, অত্যাচার, হুমকি-ভয় দেখিয়ে নিজের আধিপত্য বিস্তার করার সুযোগ লুপে নিচ্ছে। ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়ানোর বেশ কিছু কারণের প্রধান তিনটি হলোÑপ্রথমত, নেতৃত্বের প্রতি ভালোবাসা, অন্যায়ের বিপক্ষে বলিষ্ঠতা অর্জন, প্রতিবাদী চিন্তা ও অধিকার আদায়ের উদ্যমতা, পারিবারিক উৎসাহ কিংবা পরিবার রাজনৈতিক কার্যকালাপের সাথে সংশ্লিতা থাকার কারণে রাজনীতিমুখী হয়ে ওঠা। দ্বিতীয়ত, সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার জন্য কিংবা ক্ষমতা-প্রভাব বিস্তারের জন্য করে থাকে। একজন প্রোথিতযশা অধ্যাপক বলেছেন, এটা ছাত্ররাজনীতি নয়, এটা হলো স্বার্থপরদের রাজনীতি। যারা অধিকাংশই মারামারি-হানাহানিতে, হুমকি-ধমকি, ক্রদ্ধ-হিংস্রাপরায়ণ মনোভাব নিয়ে রাজনীতিতে নেমে পড়ে। তৃতীয়ত, সুবিধাবাদী ছাত্র, যারা মূলত ভয়ে অথবা গা-বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন কার্যক্রমে উপস্থিত হয়। রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার পালাবদল
হলে তাদেরও রূপ-রঙ্গের পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়। এছাড়া বামধারার রাজনৈতিক দল আছে
যারা প্রচুর অধ্যবসায়ী হয়ে থাকে। বলতে চায় নানারকমের অধিকার ও বৈষম্যহীন সমাজের কথা এবং মাঝেমধ্যে আন্দোলনের মাঠেও তুমুল
বিদ্রোহী হয়ে মাঠে নেমে পড়ে। এদের গত শতাব্দীতে যথেষ্ট প্রভাব ও কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তাদের অবস্থান সংকীর্ণ বলা যায় দুটি কারণে সেগুলো হলো ধর্মীয়-ভৌগোলিক কারণে।
এদের বাইরেও বঙ্গে ধর্মকেন্দ্রিক ছাত্ররাজনৈতিক দলগুলোয় বিশাল একটা অংশজুড়ে ছাত্ররা লেপ্টে আছে আঠার মতো।
মুসলিম-হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মকেন্দ্রিক গড়ে
ওঠা ছাত্র আন্দোলনগুলোকে বিভিন্ন আন্দোলনে মাঠে দেখা মিলে। কিন্তু দেশ-দশের কাছে নানা কারণ তাদের গ্রহণযোগ্যতা কম। অন্যতম কারণ অনেকেই মনে করছেন, রাষ্ট্রপক্ষের আত্মসমর্থনের অভাব ও প্রভাব।
সর্বোপরি গাণিতিক বিচারে এই কয়েক শ্রেণির ছাত্ররাজনীতির কথা আলোচনা-সমালোচনায় আসলেও মূলধারার ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যত দিন বর্তমান ছাত্ররাজনীতির চিত্র মিলবে না তত দিন মৌলিক উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। স্বাভবিকভাবে দেখা যায়, বর্তমানে অভিভাবকদের ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অনীহা বেড়েই চলছে। দেশ স্বাধীনের আগে ও কিছু সময় পরে দেখা যায় অভিভাবকরা আদর করে সন্তানের মুখ মুছে রাজনীতি তথা অধিকার আদায়ের জন্য উৎসর্গ করতেন। কিন্তু বর্তমানে তার বিপরীত হওয়ার কারণ কী? কেন বরাবরের মতোই অনিরাপত্তা ও ভয়-আতঙ্কের উপদ্রব মনে করেন ছাত্ররাজনীতিকে। অনেকে একচেটিয়াও অতিআক্রশী হয়ে গলা পাটিয়ে বলে বেড়ান এই শিশুরাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোকÑকেননা তা দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির অন্যতম বাধা। শিশুরাজনীতি বলেন শিশুসুলভ কার্যক্রমের জন্য। দেশের উন্নতির সঙ্গে প্রশ্ন তুললে প্রশ্ন আসে তাহলে কি উন্নত দেশগুলোয় ছাত্ররাজনীতি নেই? উত্তর হলো অবশ্যই আছে। ইউরোপ-আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলোয় সুষ্ঠুধারার ছাত্ররাজনীতি চর্চা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেমনÑডেনমার্কের রাজনীতিতে ছাত্রদের প্রধান দুটি দল অংশ নেয়। তাদের একটি হলো, লিবারেল স্টুডেন্টস অব ডেনমার্ক আর অন্যটি কনজারভেটিভ স্টুডেন্টস (ডেনমার্ক)। উভয় দল কাউন্সিলের মাধ্যমে তাদের নেতা নির্বাচন করে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নেয়
রাজনীতি করা ছাত্ররা। এরকম অহরহ উদাহরণ আছে; যাতে দেখা যায় ছাত্ররাজনীতি দেশের উন্নয়নের কাজে দারুণভাবে কাজে লাগে। অস্ট্রিয়া-ইংল্যান্ডেও ছাত্ররাজনীতির শুভ-সুষ্ঠু চর্চার কথার বেশ শুনাম-সুখ্যাতি আছে। তবে আমাদের পূর্বের ছাত্ররাজনীতি উন্নত দেশের ছাত্ররাজনীতির
তুলনায় নিঃসন্দেহে বেশি আলোকিত। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি ছাত্ররাই প্রথম ভাষার জন্য, দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছে। প্রকৃতার্থে ছাত্রদের রাজনৈতিক একটা মাঠ
জরুরি যেখান থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে
সমাজ-রাষ্ট্রে পরিচালনার জন্য দক্ষ জনশক্তি ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের মন-মেজাজ, মাথা-মগজ বাড়াবে। কবে সেই পথে চলবে বঙ্গীয় ছাত্ররাজনীতি? এই আশায় তাকিয়ে আছে এই বাংলা ও বাঙালী।
শিক্ষার্থী
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়