আমাদের আদি পেশা কৃষি

আব্দুর রউফ: পৃথিবীর ইতিহাসে সমাজ ও সভ্যতা বিকাশে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। যতই এই পৃথিবীর বয়স বেড়েছে ততই পেয়েছে নতুনত্ব। সেই আদিম সমাজ থেকে আজকের একুশ শতকের আধুনিক পৃথিবী অবধি নীরবে সমাজ ও সভ্যতা বিকাশে অবদান রেখেই চলছে কৃষি। পৃথিবীর এই ধারাবাহিক পরিবর্তনের সবচেয়ে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কৃষির আবিষ্কার। কৃষি আবিষ্কারের আগে মানুষ যাযাবর জীবনযাপন করত। খাবারের সন্ধানে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়াত। তৎকালীন আদিম সমাজের জীবনযাপনের একমাত্র ভরসা ছিল পশুপাখি শিকার ও প্রকৃতির দয়ার ওপর নির্ভরশীলতা। কৃষি আবিষ্কারের ফলেই মানুষের জীবনে এসেছিলে স্থিতিশীলতা। মানুষ শিখেছে কীভাবে সমাজবদ্ধ হয়ে একই স্থানে বসবাস করা যায়। আদিম সমাজ বেশকিছু যুগ অতিক্রম করে নব্য প্রস্তর যুগে এসে কৃষি আবিষ্কার করে, যে আবিষ্কার মানবসভ্যতা বিকাশে পৃথিবীকে এক ধাক্কায় অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে এসেছে। পৃথিবীর সেই পরিবর্তন এখনও চলমান।

প্রাচীনকাল থেকেই কৃষি বাঙালির অন্যতম জীবিকার উৎস। এই উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের অবস্থাও প্রায় অভিন্ন। কিন্তু প্রায় গোটা বাংলায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতসহ তিনটি প্রধান নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এবং তাদের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা প্রসারিত পলিগঠিত সমভূমি হওয়ার দরুন প্রাচীনকাল থেকেই এখানে কৃষিকাজ অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। বিশেষ করে প্রাচীন, মধ্যযুগ ও ব্রিটিশ আমলে কৃষি অর্থনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপখাত হিসেবে শস্য উৎপাদন অত্যধিক প্রাধান্য পেত। প্রায় প্রাচীনকাল থেকেই কৃষির পাশাপাশি অন্য তিনটি উপখাত, যেমন পশুসম্পদ, মৎস্য ও বনকে অপেক্ষাকৃতভাবে গুরুত্বহীন হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তৎকালীন সমাজের মানুষ নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস করার জন্য কৃষির দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছিল। বিশেষ করে নিত্যনতুন হাতিয়ার আবিষ্কৃত হওয়ায় কৃষিকাজ আরও সহজ হয়ে উঠেছিল।

আদিম সমাজের মানুষ যখন বুঝতে পারল, মাটিতে কোনো বীজ পুঁতে রাখলে তা থেকে গাছ জন্মায়, ঠিক তখন থেকেই মানুষ যাযাবর জীবন পরিত্যাগ করে কৃষি ও পশুপালনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। ঠিক তেমনি ইতিহাস বলে আমাদের অন্যতম আদি পেশা কৃষি। আদি পেশাগুলোর মধ্যে একমাত্র কৃষিই শক্তভাবে টিকে রয়েছে। আশা করা যায়, যত দিন পৃথিবী থাকবে তত দিন এই মহৎ পেশা বিলুপ্ত হবে না। শুধু পৃথিবীর ইতিহাস নয়, বরং কৃষি বাংলাদেশের ইতিহাস ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দীর্ঘ সময় ধরে অবহেলিত ও শোষিত এই বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কৃষি নীরবে ভূমিকা রেখে চলছে। তাই এখনও কৃষির কোনো বিকল্প নেই। আধুনিক সমাজে কৃষিকাজের নিত্যনতুন যন্ত্রপাতির আবিষ্কার আধুনিক কৃষি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেই চলছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কারণে শোষিত-নিপীড়িত কৃষক সমাজে ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং যুগে যুগে এই কৃষকসমাজ নানা কারণে তাদের যৌক্তিক অধিকার বুঝে পায়নি।

কৃষি আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই এদেশের অবহেলিত কৃষকসমাজ জীবিকার তাগিদে লড়াই করেই চলছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্য পেশার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটলেও কৃষক সমাজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতি মোকাবিলা করে কৃষকরা সযত্নে ফসল ফলায়। অথচ দিন শেষে তারা তাদের প্রাপ্য মূল্যায়নও পায় না। যদিও বর্তমান সরকার কৃষকদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে সেই পদক্ষেপের সুফল প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত কৃষকদের সরকারি সেবা পৌঁছে দিতে সরকারকে আরও বেশি কঠোর হতে হবে। সরকারি সেবাগুলো কৃষক পর্যন্ত ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে কি না তার জন্য কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

তাই দেশের কৃষকদের এই পথচলা এতটা মসৃণ নয়। দেশে প্রত্যহ আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। তারপরেও এই বাংলার কৃষক সমাজ নিষ্ঠার সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে নিরলস চেষ্টা করে চলছে। দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে কৃষক সমাজের ভূমিকা প্রমাণ করে কৃষি হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা। তাই কৃষি ও কৃষকদের সমৃদ্ধ করতে সরকারের আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। কৃষকদের মধ্যস্বত্বভোগীদের কবল থেকে রক্ষায় সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে বর্তমান তরুণ প্রজš§কে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে কৃষি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। কৃষিতে নিত্যনতুন আবিষ্কৃত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ, সেহেতু অল্প জমিতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে অধিক ফসল ফলানোর ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষকদের কৃষি কার্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সরকারি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষকদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নির্দিষ্ট বয়সের পর কৃষি ভাতা চালু করতে হবে। কারণ কৃষিই একমাত্র পেশা যার মাধ্যমে একজন মানুষ দীর্ঘদিন রাষ্ট্রকে সেবা দিয়ে থাকেন। একই সঙ্গে এই ২১ শতকে এসে পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে পাল্লা দিতে হলে অবশ্যই আধুনিক কৃষির ওপর জোর দেয়ার বিকল্প কিছু নেই। যদিও বর্তমান সময়ে তথাকথিত কিছু শিক্ষিত মানুষ কৃষিকাজকে আড়চোখে দেখেন। অনেকেই বাপ-দাদার এই মহৎ পেশাটিকে পরিচয় হিসেবে বলতে লজ্জাবোধ করেন। কিন্তু ইতিহাস বলে আমাদের আদি পেশা কৃষিই। যারা নিজেদের শিকড়কে ভুলে যায়, তারা কখনও পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারে না। তাই কৃষি পেশাকে অবহেলার চোখে দেখার সুযোগ নেই। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে কৃষির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তা রক্ষায় রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেই প্রত্যাশা।

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০