আমাদের টার্গেট প্রতিটি শাখায় প্রতি মাসে অন্তত একজন নতুন উদ্যোক্তা খুঁজে বের করা

মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। ২৪ আগস্ট ২০১৬ থেকে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত কর্মসংস্থান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে স্নাতক এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে ফিন্যান্স বিষয়ে এমবিএ করেন। এছাড়া তিনি আইবিএ’র ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। কৃতিত্বপূর্ণ ছাত্রজীবনের পর কর্মক্ষেত্রেও অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সম্প্রতি শেয়ার বিজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন সোনালী ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ব্যাংকের ভূমিকা প্রসঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শামসুন নাহার

শেয়ার বিজ : ব্যাংকিং পেশায় আসার গল্পটি বলুন…

মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ : খুবই সাধারণ গল্প। আমার মামা একজন ব্যাংকার ছিলেন। তখন তাকে দেখে খুব ছোটবেলা থেকেই অনুপ্রাণিত হতাম আর ভাবতাম, আমিও ব্যাংকার হবো। অনেকেরই ছোটবেলার স্বপ্ন পরিণত বয়সের ইচ্ছার সঙ্গে মেলে না। আমার ইচ্ছাটা পরে আর বদলায়নি। বাণিজ্য বিভাগ নিয়েই লেখাপড়া করেছি। তাই ছাত্রজীবন শেষে ব্যাংকে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করি।

শেয়ার বিজ : কর্মসংস্থান ব্যাংকে আপনার উদ্যোগে নেওয়া প্রকল্পগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন…

ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ : কর্মসংস্থান ব্যাংকটি এক ব্যতিক্রমী ব্যাংক। কারণ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি ও মানবসম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। আমার দায়িত্ব চলাকালে চেষ্টা করেছি শ্রেণিকৃত ঋণ কমাতে। এছাড়া নতুন পদক্ষেপ হিসেবে যে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে, তা ব্যাংকটির জন্য খুবই ভালো ফল বয়ে এনেছে। যেমন, দুগ্ধশিল্পে ঋণ দেওয়া ও বাজারজাতকরণে সহায়তা করার প্রকল্পটি অনেক বেকার যুবকের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশে একেক এলাকা একেক পণ্যের জন্য বিখ্যাত। যেমন সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর এলাকায় ভালো মানের দুধ পাওয়া যায়। এসব জায়গায় আড়ং, মিল্ক ভিটা, প্রাণসহ অনেক কোম্পানির মালিকানায় দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ খামার রয়েছে। কর্মসংস্থান ব্যাংক কিছু বেকার যুবককে দুগ্ধখামার করতে ঋণ দেয়। পাশাপাশি এসব বড় কোম্পানির মাধ্যমে তাদের পণ্যের বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করি। এতে নতুন উদ্যোক্তাদের পণ্যের বাজারজাতকরণ নিয়ে ঝুঁকিতে পড়তে হয়নি। ফলে এ প্রকল্পটিতে শতভাগ সফলতা পেয়েছি। এ ধরনের ঋণ প্রকল্প চালুর জন্য সোনালী ব্যাংকেও কাজ করছি।

শেয়ার বিজ : অনেক ক্ষেত্রেই এসএমই ঋণের সুবিধা প্রকৃত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ভোগ করতে পারছেন না। এ ব্যাপারে করণীয় কী?

ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ : এটা ঠিক যে, ঋণ পাওয়া ও উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণে নতুন উদ্যোক্তাদের আরও অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। কর্মসংস্থান ব্যাংকের দুগ্ধশিল্প ঋণের পুরোটা প্রকৃত উদ্যোক্তারাই পেয়েছেন। কারণ আমরা সরেজমিনে যাচাই করে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে ঋণ দিয়েছি। একই পদ্ধতিতে সতর্কতার সঙ্গে ঋণ দিলে অন্যান্য প্রকল্পেও প্রকৃত উদ্যোক্তারা উপকৃত হবেন। যেমন অগ্রণী ব্যাংকে দায়িত্ব পালনকালে বান্দরবান, সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় আদা চাষ প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করি। সে বছর আদার বাম্পার ফলন হয় এবং বান্দরবানের আদা অনেক জনপ্রিয় হয়। এমনকি ভারত ও চীন থেকে আমদানি করা আদার চেয়ে ভালো মানের এ পণ্যটির উৎপাদন বেশি হওয়ায় এর দরপতনও হয়েছিল। এ কারণে পরে প্রকল্পটি বাদ দিতে হয়। এক্ষেত্রে যদি শুল্কারোপের মাধ্যমে আমদানি কমিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে স্থানীয় আদাচাষি উপকৃত হতে পারতো। মূল কথা, ঋণ দেওয়ার পর উৎপাদিত পণ্যের মার্কেটিংয়ে সহায়তা করতে পারলেই উদ্যোক্তাদের প্রকৃত অর্থে সাহায্য করা হবে। এমনকি কৃষিতেও এ ব্যবস্থা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে কৃষক ও চেইনশপ, সুপার স্টোর ইত্যাদির মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভব। এভাবে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে কৃষক ও প্রকৃত ভোক্তার মধ্যকার দূরত্ব কমাতে পারলে উভয় পক্ষই লাভবান হবে। পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই করে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে ঋণ প্রদান ও মার্কেটিং সহায়তা প্রদান করতে পারলেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের প্রকৃত ও টেকসইভাবে সাহায্য করা সম্ভব।

শেয়ার বিজ : বর্তমানে বিনিয়োগ সম্ভাবনা সম্পর্কে আপনার মত কী?

ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ : দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টিতে অনেক কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে। সম্প্রতি কয়েকটি বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যা বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি অবদান রাখবে। যেমন পদ্মা সেতু চালু হলেই জিডিপি দেড় থেকে দুই শতাংশ বেড়ে যাবে। বেশিরভাগ অবকাঠামো তৈরির কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে এর আধুনিকায়ন প্রয়োজন। যেমন রাস্তাঘাট, জলপথ, রেলপথ রয়েছে; কিন্তু ধীরগতি, যানজটসহ নানা সমস্যা রয়ে গেছে। এখন এসব সমস্যা দূর করতে রাস্তা প্রশস্তকরণ, ফ্লাইওভার তৈরি, মেট্রোরেল প্রকল্প ইত্যাদি কাজ করা হচ্ছে। এছাড়াও কিছু পাওয়ার প্রজেক্টের কাজ হচ্ছে। শিল্পায়ন বৃদ্ধিতে ইকোনমিক জোন করা হচ্ছে। কেবল আবাসন খাতটি পিছিয়ে আছে। আবাসন খাতের সঙ্গে আরও ৫৭ ধরনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জড়িত। উন্নয়নমূলক কাজের ধারাবাহিকতায় এ খাতের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উপখাতগুলোও ভালো করবে। সুতরাং বিনিয়োগের পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি হচ্ছে এবং এর সুফল অদূর ভবিষ্যতেই আমরা পেতে যাচ্ছি।

শেয়ার বিজ : সম্প্রতি তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি কি এতে সহায়তা জোগানোর জন্য প্রস্তুত?

ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ : আমি মনে করি, দেশের অর্থনীতির জন্য বর্ধিতসংখ্যক উদ্যোক্তা সুফলই বয়ে আনবে। আর এসব উদ্যোগকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো সামর্থ্যও বাংলাদেশের রয়েছে। অর্থই অধিকাংশ ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধান করতে পারে। আমাদের বড় অঙ্কের রিজার্ভ রয়েছে। এছাড়া ২০০৭-০৮ সাল হতে দেশের ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার জন্য এসএমই খাতকে প্রাধান্য দিচ্ছে। বর্তমানে বড় ঋণের চেয়ে এসএমই ঋণ নিয়েই কাজ হচ্ছে বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এসএমই ঋণের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছে। সোনালী ব্যাংকের টার্গেট রয়েছে, প্রতিটি শাখায় প্রতি মাসে অন্তত একজন নতুন উদ্যোক্তা খুঁজে বের করতে হবে। এমনও হয়েছে, উদ্যোক্তা পাওয়া যায়নি বলে এসএমই খাতে বরাদ্দ করা টাকা আমরা ব্যাংকে ফেলে রেখেছি; কিন্তু অন্য খাতে দিইনি। উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতায় সহায়তার জন্য আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সচেষ্ট রয়েছি। আবার বড় কোম্পানিগুলোও নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য হুমকি নয়। কারণ জায়ান্ট কোম্পানিগুলো ছোট উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগী নয়। বরং একটি বড় কোম্পানি পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়ে থাকে। সুতরাং উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই থাকবে এবং বর্ধিতসংখ্যক উদ্যোক্তা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে।

শেয়ার বিজ : সাম্প্রতিক কিছু কেলেঙ্কারির পর সোনালী ব্যাংক কীভাবে সুনাম পুনরুদ্ধার করবে?

ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ : উল্লেখযোগ্য কিছু দুর্ঘটনার পরও সোনালী ব্যাংক মানুষের আস্থার কারণেই এগিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাংক সরকারের পক্ষ থেকে ট্রেজারি গ্রহণ করে এবং সরকারি ভাতা, বৃত্তি ইত্যাদি মানুষের মাঝে প্রদান করে। আমাদের মাধ্যমে সরকার ২০টিরও বেশি সেবা দিয়ে থাকে, যার জন্য সোনালী ব্যাংক কোনো চার্জ নেয় না। এসব কারণে দেশের মানুষের সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের যোগাযোগ ও আস্থার সম্পর্ক আরও জোরালো হয়েছে। ফলে প্রতি মাসেই এ ব্যাংকের ডিপোজিট বাড়ছে। আর ব্যাংকিংয়ে বিভিন্ন রকম ঝুঁকি থাকেই। কিন্তু এর জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে—সেটিই আসল। আমি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষপাতী। জালিয়াতি বা খেলাপির ঘটনা ঘটলে আইনের মাধ্যমেই সুরাহা হবে। হলমার্কসহ অধিকাংশ মামলার রায় আমাদের পক্ষে এসেছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আইন ব্যবস্থাপনা আরও সবল হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বড় দুর্নাম হলো খেলাপি। সোনালী ব্যাংক খেলাপি রোধে খুব সতর্কভাবে অগ্রসর হচ্ছে। এখন যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আমি মনে করি, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চাইলেই বহিরাগত কোনো মহল দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে খেলাপি রোধ করতে পারেন।

শেয়ার বিজ : বেসরকারি ব্যাংকের মতো আধুনিকায়ন কি সোনালী ব্যাংকেও সম্ভব?

ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ : আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেও প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকটি অনেক বড় হওয়ায় প্রাইভেট ব্যাংকের মতো আধুনিকায়ন সহজ নয়। কারণ আমাদের দেশব্যাপী অনেক শাখায় বিপুলসংখ্যক গ্রাহক নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করতে হয়। বেশি ঝুঁকি নিতে হয়। এটি প্রাইভেট ব্যাংক করে না। তারা সফল ও প্রমাণিত গ্রাহক নিয়ে কাজ করে। তাই আধুনিকায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রাইভেট ব্যাংকের যতটা সহজ, আমাদের জন্য ততটা নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক অগ্রাধিকার দেয় বেশিসংখ্যক মানুষকে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করায়। ধীরে ধীরে সোনালী ব্যাংকও টার্গেট নিয়ে আধুনিকায়ন ও সেবার মান বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

শেয়ারবিজ : আপনাকে ধন্যবাদ।

ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০