আমাদের ডলারগুলো যায় কোথায়?

মোহাম্মদ আবু নোমান: আমাদের ডলার-সংকট যায় না কেন? আমাদের অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা তো কমেনি। আমাদের রপ্তানি আয় বেড়েছে। তাহলে আমাদের ডলারগুলো যায় কোথায়? আমাদের অর্থমন্ত্রী বাজেটে রাখঢাক না রেখেই বলেছিলেন, ‘দেশের ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।’ বাংলাদেশ দুটো ক্ষেত্রে পৃথিবীর শীর্ষ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে, এক হলো কোটিপতি উৎপাদনে, আরেক হলো দেশের টাকা বিদেশে পাচারের ক্ষেত্রে। দেশ থেকে ডলার বিদেশে পাচার করেন বড়লোকেরা, শিক্ষিতরা। লন্ডন, কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ডে যারা আছেন, তারা পেশাজীবী ও শিক্ষিত। তারা সেখানে গিয়ে বাড়ি-গাড়ি করার জন্য দেশে অন্যায় পথে অর্জিত জমিজমা, ফ্ল্যাট বিক্রি করে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার অবৈধভাবে পাচার করে নিয়ে যান। এছাড়া দেশে যারা নানা পর্যায়ে অবৈধ আয় করেন; যেমন- সরকারি চাকরি করে কোটি কোটি টাকা ঘুষ খাওয়া, ঋণ পরিশোধ করতে হবে না এই চিন্তা থেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া, চোরাকারবার, মাদক ব্যবসা, শেয়ারবাজার লুটেরা, ভেজাল ব্যবসা করে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা, বিদেশে লোক পাচার, দখল-চাঁদাবাজি, সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করে শতকোটি টাকা লুট প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত টাকা তারা দেশে রাখতে পারেন না। কেননা তাদের প্রতিক্ষণই ভাবনা হলো- ‘এত টাকা দেশের কোথায়, কী করে, কার কাছে রাখব? আয়ের উৎস দেখাব কী? নিরাপত্তাই কী? তাছাড়া আগামী এক বছর পরে নির্বাচন, দেশের অবস্থা কী হয়, না হয়।’ ক্ষমতার দাবা উল্টে গেলেও ভবিষ্যৎ থাকা-খাওয়া নিশ্চিত করার ভাবনায় নির্বাচনের আগে তাদের ডলার পাচারের হার বেড়ে যায়। এর আগে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির পক্ষ থেকে ডলার পাচারের একটা চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। তা হলো, ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে বিদেশে টাকা পাচারের হার বেড়ে গিয়েছিল ৫০ শতাংশ। ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা সরকারি ঠিকাদারির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাভোগী একটি অংশ সরকারের মেয়াদের শেষদিকে দেশের বাইরে অর্থ-সম্পদ সরিয়ে নেয়, সেটা বিভিন্ন দেশেই দেখা যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম বিদ্বেষ, খুন, গুম ও হানাহানির কারণে দেশে বাস করা ও টাকা রাখা নিরাপদ মনে করেন না।

অন্যদিকে আমাদের রেমিট্যান্স আনেন বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার গরিব শ্রমিকেরা। দেশের দিনমজুরেরা কল-কারখানায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাকা ঘোরান, ফসল ফলান ও রেমিট্যান্স আনেন। অল্প মজুরির পোশাকশ্রমিকরা আমাদের অর্থনীতি চাঙা রাখেন। অথচ আমাদের কতিপয় শিক্ষিতজনদের কাজই হলো বিদেশে টাকা পাচার করা। আর দেশের সর্বসাধারণকে নানাভাবে শোষণ করা।

এছাড়া অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হয় বাণিজ্যের আড়ালে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান জানিয়েছেন, আমদানি পণ্যের দাম ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেখানোর ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংকিং ও কাস্টমস পরিভাষায় এই বাড়িয়ে দেখানোর নাম ‘ওভার ইনভয়েসিং’। বাংলাদেশের অর্থ পাচারের বেশিরভাগ সংঘটিত হয় আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে ‘মিস ইনভয়েসিং’ বা চালান জালিয়াতির মাধ্যমে, যার ফলে একদিকে যেমন ব্যাপক কর ফাঁকি সংঘটিত হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। যদি প্রশ্ন করা হয়, কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার হয়? সহজ কথায় তার জবাব হলো, ওভার ইনভয়েসিং। অর্থাৎ কর ফাঁকি দিতে, কোম্পানির মুনাফা লুকাতে এবং অন্যান্য কারণে পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে অনেক সময় পণ্যের প্রকৃত মূল্য দেখানো হয় না। অর্থাৎ, কেউ ১০০ টাকার পণ্য আমদানি করবে, দেখানো হলো পণ্যের দাম ১৫০ টাকা। এর ফলে ৫০ টাকা পাচার হয়ে গেল। রপ্তানির ক্ষেত্রে করা হয় উল্টোটা। ১০০ টাকার পণ্য রপ্তানি করলে, কিন্তু দেখানো হলো ৫০ টাকা। বাকি ৫০ টাকা বিদেশে রয়ে গেল। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে পণ্য সরবরাহকারী কিংবা ব্যাংক বা শুল্ক কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ অবশ্যই থাকে। যদি বাড়তি ব্যয় দেখানো না হতো, তাহলে আমদানি ব্যয় এত হতো না। সর্বশেষ গত ১৪ নভেম্বর ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আন্ডার ইনভয়েসিং বা পণ্যের দর কম দেখানোর চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, ‘এক কেজি কমলা ১২ টাকা, কিংবা আপেল ১৮ টাকায় আমদানির তথ্য পাওয়া পাচ্ছে। এর মাধ্যমে একদিকে কর ফাঁকি দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে অর্থ পাচারের মাধ্যমে পণ্যমূল্যের বাকি অংশ অবৈধভাবে পরিশোধ করা হচ্ছে।’

গত ১৭ নভেম্বর রাজধানীতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আয়োজিত এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-বিষয়ক জাতীয় সেমিনারে আর্থিক খাতের অবস্থার ওপর বক্তৃতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্তে দেখা গেছে, চলতি বছরের শুরু থেকে দেশে অস্বাভাবিক আমদানির পরিমাণ আট বিলিয়ন ডলারের বেশি বেড়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার পর আমদানিকৃত পণ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর পাঁচ বিলিয়ন ডলারের আমদানি কমেছে। এছাড়া তিনি বলেন, তদন্তে আমরা দেখেছি, কিছু পণ্য ২০ থেকে ২০০ শতাংশ ওভার ইনভয়েসিং দিয়ে আমদানি করা হয়েছে।’ বিদেশে নগদ ডলার কেউ বস্তায় ভরে নিতে পারে না। আমরা বলতে চাই এ ধরনের ঘটনা যাচাইয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই কি?

এর আগে আমরা খবর দেখেছি, বিদেশে টাকা পাচারে বাংলাদেশ শীর্ষে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রাক্কলন বলছে, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং বা কম মূল্য দেখানো এবং ওভার ইনভয়েসিং বা বেশি মূল্য দেখানোর কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের বছরে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের গরমিল রয়েছে, স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ক্রমবর্ধমান অর্থ পাচার বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ যে গগনচুম্বী, এ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। আর এটা বুঝতে বড় কোনো অর্থনীতিবিদ হতে হয় না।

জিনিসপাতির দাম যে বেড়ে যাওয়া দেশের বেশিরভাগ মানুষই এখন ভালো নেই। মানুষ বাজারে গিয়ে পকেট খালি করে ফিরছেন, কিন্তু অতি জরুরি খাদ্য বা নিত্যপণ্য কিনতে পারছেন না। বাস্তবতা যে কতটা ভয়াবহ, তা সাধারণ মানুষ যাদের বৈধ আয় দিয়ে বাজার করতে যেতে হয়, তারাই জানে। এসবের জন্য যদিও দায়ী করা হয় করোনা-উত্তর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে, যেখানে আমদানি বেড়ে গেলেও রপ্তানি না বাড়া, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা, তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ইউক্রেন থেকে খাদ্যপণ্য আমদানিতে সমস্যা প্রভৃতি। কিন্তু এসবের মধ্যে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ডলার পাচার। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি নামক প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, ২০০৮-১৫ মেয়াদে চালান জালিয়াতির মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ বছরে ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার (অর্থাৎ ৭১ হাজার কোটি টাকা)।

প্রবাসীরা যদি প্রতি ডলার/ইউরোতে ব্যাংকের চেয়ে বাইরে ১০ টাকা বেশি পায়, তাহলে তারা কোনোমতেই ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে চাইবে না। প্রতি লাখে যদি ১০ হাজার টাকার পার্থক্য হয়, তাহলে অবশ্যই কেউই অতি জরুরি লিমিটেড অ্যামাউন্ট ছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাবে না। বিনিময়ের হার ঠিক করা বেশ জরুরি, কারণ দেশপ্রেম বিনিময়ের হারের কাছে বেশিক্ষণ টিকবে না। হুন্ডির নতুন নতুন ধরন বা পদ্ধতি বের হয়েছে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে হুন্ডি বন্ধ হবে না। শত বছর ধরে হুন্ডি টিকে আছে। যত দিন চাহিদা থাকবে, তত দিন হুন্ডি হবে। এটি অর্থনৈতিক বিষয়, অর্থনৈতিকভাবেই এর সমাধান করতে হবে। এমন সব পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে প্রবাসীরা বৈধ পথে অর্থ পাঠাতে আগ্রহী হন। এজন্য রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। তারা যেকোনো জায়গায় বসে যাতে তাৎক্ষণিকভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে। সেসব সুবিধার কারণে প্রবাসীরা হুন্ডির আশ্রয় নেন, এমএফএস মাধ্যমে বৈধভাবেই সেসব সুবিধা পাওয়া যায়। তবে এ সুবিধা কাজে লাগানোর উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে।

বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় স্কিম করা গেলে বৈধ পথে প্রবাসীদের অর্থ পাঠানো বাড়বে। হুন্ডি বন্ধ হোক, বিদেশিরা এটি চায় না। সিঙ্গাপুরের মতো দেশে রাস্তায় সিগারেটের ছাই ফেললেও পুলিশ হাজির হয়। সেখানে উš§ুক্ত পরিবেশে হুন্ডি কার্যক্রম চালানো হলেও পুলিশ কিছু বলে না।

কভিড ও রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন পৃথিবীর ধনি-দরিদ্র সব দেশকে বিপদে ফেলেছে। দুর্ভিক্ষ হতে পারে, এমন ঘোষণার পেছনে দুটি বিষয় কাজ করে থাকতে পারে। একটি হচ্ছে, সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দায় আগামী দিনে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় হ্রাসের সম্ভাব্য ঝুঁকি। অন্যটি হচ্ছে, ওপেকভুক্ত দেশের জ্বালানি উৎপাদন কমিয়ে আনাসহ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি। সেই কারণে আগেভাগেই দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকারের নিজস্ব ভুল পরিকল্পনার সংকটকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্বমন্দার ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে মাত্র। বাংলাদেশের আজকের সংকট আমাদের ওপর শতভাগ আরোপিত নয়; বরং আমরা নিজেরাই যে চলমান ডলার-সংকটের একটা বড় অংশের নির্মাতা, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

সাংবাদিক

abunoman1972@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০