কাজী সালমা সুলতানা:‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা।’ ভাষা আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার ৭০তম দিবস আজ। ভাষা দিবসের প্রাক্কালে বায়ান্নর ভাষাশহিদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, আউয়াল, অহিউল্লাহসহ সব শহীদের প্রতি অবিরাম শ্রদ্ধা। সারাবিশ্বের কোটি কণ্ঠে আজ উচ্চারিত হবে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা কালজয়ী গান‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ মাতৃভাষার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে বাঙালি জাতি যে ইতিহাস রচনা করেছিল, শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্ব তা স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধায়।
আমরাই পৃথিবীর একমাত্র জাতি, যারা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন দিয়েছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সম্মেলনে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সেজন্য ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশেও এ দিবস পালিত হচ্ছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনে বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা ও রাজনৈতিক প্রেরণা। তারই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরে ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সময় ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে কোনো মিল না থাকার পরও শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে এক হাজার ২০০ মাইল ব্যবধানের দুটি পৃথক ভূখণ্ডকে এক করে পাকিস্তন নামক একটি ধর্মরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এর সৃষ্টির শুরুতেই শুরু হয় ভাষা বিতর্ক। ভাষার দাবিতে সর্বপ্রথম আন্দোলন সংগঠিত করে তমদ্দুন মজলিস। এর নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ১৭ দিনের মাথায় (১৯৪৭ সাল) গঠিত হয় তমুদ্দিন মজলিস, এরপর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের শুরু (১৯৪৮ সাল)।
ভাষা নিয়ে প্রথম সোচ্চার হন পূর্ববঙ্গের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলায় বক্তৃতা দেন এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সেদিন পরিষদের সব মুসলমান সদস্য (সবাই মুসলিম লীগের) একসঙ্গে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ একটি স্মরণীয় দিন। এদিন ধর্মঘটের পক্ষে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই সেøাগানসহ মিছিল করার সময় শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল ওয়াহেদ প্রমুখ গ্রেপ্তার হন। এদিন ভাষার দাবিতে প্রথম হরতাল পালিত হয়। এই হরতালে নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১১ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই গ্রেপ্তার তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট। স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই বঙ্গবন্ধুর প্রথম গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা। ওইদিন তিনি পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি; প্রকাশক: বাংলা একাডেমি)। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহরের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। এই ধর্মঘট শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, পূর্ব বাংলার সর্বত্রই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ওই দিন ছাত্রসমাজ সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করে।
ভাষার দাবিতে যখন গণস্বাক্ষর অভিযান শুরু হয়, তখন থেকেই শেখ মুজিব এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ১৪ ভাষাবীর সর্বপ্রথম ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে হয়। ঘটনাবহুল এ দিবসটি ঐতিহাসিক ও সামাজিক মর্যাদায় আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যধিক গুরুত্ববহ ও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
১১ মার্চ প্রতিবাদের যে ভিত রচনা হয়েছিল, তারই সূত্র ধরে তৎকালীন সরকার ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় এবং এই সংগ্রামের পরিপূর্ণতা লাভ করে সালাম, জব্বার, রফিকের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের সিঁড়ি বেয়েই ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলন বিকাশ লাভ করে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি।
১৯৪৭ সালে যে মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, ১৯৫২ সালে উত্তাল বিক্ষোভ ও রক্তপাতের মাধ্যমে তা পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা না পেলেও বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। একই বছর (১৯৫৬) ৩ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানকারী পাকিস্তানের সংবিধান কার্যকর করা হয়। এর মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে তমদ্দুন মজলিশের মায়ের ভাষায় কথা বলার যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার সাফল্য অর্জিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জনের পর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ৩ অনুচ্ছেদে ঘোষণা দেয়া হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রথম বাংলায় বক্তব্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান বিশ্বসভায় বাংলাকে তুলে ধরেন।
১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালে বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান সরকারি কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রথম সরকারি নির্দেশ জারি করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভাষা-আন্দোলনেরই সুদূরপ্রসারী ফলাফল।’ (দৈনিক সংবাদ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৫)।
আজ স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও আমরা এখনও সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে পারিনি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বাংলা চালু থাকলেও বাংলা এখনও উচ্চশিক্ষার বাহন হয়নি।
আজ ব্যংক-বিমাসহ দেশের সব প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা দেখানো হয়। দেশজুড়ে সাইনবোর্ডগুলোয় শুধুই ইংরেজি ভাষা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য ভাষার ব্যবহারও দেখা যায়।
বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশলসহ বহু বিষয়ে বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করা সম্ভব হয়নি। ফলে এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। অথচ জাপান, কোরিয়াসহ বহু দেশ মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার সব দরজা খুলে দিয়েছে, যাদের লোকসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম।
কয়েক দশক ধরে বাংলা ভাষার বিকৃতিও হয়েছে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। সন্তান ইংরেজিতে কথা বললেই অনেক অভিভাবক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বাংলা বলতে গিয়ে ইংরেজি বলার একটা বিচিত্র প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেক ছেলেমেয়ের মাঝে এখন এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে গেছে। এভাবে কথা না বললে যেন তাদের মর্যাদাই থাকে নাÑএমন একটা ভাব।’
যদিও আজকের যুগে অবশ্যই বহু ভাষা জানা প্রয়োজন। তাই বলে সবার আগে নিজের ভাষাকে শুদ্ধভাবে বলতে ও লিখতে পারা গুরুত্বপূর্ণ। আর এটিই হতে পারে ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রেষ্ঠ উপায়।
গণমাধ্যমকর্মী
salma15august@gmail.com