আমাদের শিক্ষকরা কি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার!

সুধীর বরণ মাঝি: শিক্ষক সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও সমাদৃতÑএতে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। তবে সময় ও স্থানভেদে এর তারতম্যও চোখে পড়ে। একজন শিক্ষক সর্বদাই শিক্ষাবান্ধব ও শিক্ষার্থীবান্ধব। তিনি শিক্ষার পাশে দাঁড়ান, শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ান, শিক্ষার্থীদের পথ দেখান সত্য ও ন্যায়ের পথে পথ চলতে। সেই সঙ্গে তার চিন্তা ও বিবেচনাবোধ থাকবে সীমাহীন, যার কাছ থেকে ছাত্ররা সত্যকে সত্য বলতে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে শেখে, বলার সাহস সঞ্চয় করেÑহোক তা যতই কঠিন। তারা শিক্ষার্থীদের শেখান সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা গেলেও কোনো কিছুর বিনিময়েই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না। আর তাই তারা স্থান ও কালভেদেও শ্রদ্ধেয় ও সমাদৃত।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হলে শিক্ষকরা হলেন স্নায়ুতন্ত্র, যার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় জ্ঞানের নতুন ধারা, নতুন সভ্যতা। শিক্ষক সর্বদাই মানবিক, নৈতিক ও আদর্শিক, যিনি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার। একজন শিক্ষক ছাত্রদের মাধ্যমে সমাজকে নতুন নতুন স্বপ্নের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, গভীর সংকটেও আলোর পথ দেখান, সমাজ, পরিবার, ব্যক্তিজীবনের সম্প্রীতির বন্ধন, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ও পরিবেশ সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন।

তিনি প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করেন সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করতে। একজন শিক্ষকই সমাজে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠা করতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যিনি শিক্ষক তিনি ছাত্রদের শুধু পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন না। শুধু পরীক্ষায় পাসের জন্যই শেখানো শিক্ষকের কাজ নয়, তিনি শেখান জীবনকে জানার জন্য, জীবনকে বোঝার জন্য এবং জীবনকে সুষ্ঠুভাবে অতিক্রান্ত করার জন্য। তিনি নতুন নতুন সৃজনশীল চিন্তাকে জাগিয়ে তোলেন।

শিক্ষকের সীমাহীন ত্যাগ, শ্রম ও মেধার কারণেই আমরা আজ সভ্যতার উচ্চ শিখরে উন্নীত হয়েছি। শিক্ষক শ্রমজীবী থেকে শুরু সব শ্রেণির মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হন। আবার তিনি নিজেও শ্রমজীবী মানুষকে শ্রদ্ধা করেন, তেমনি ছাত্রদের শেখান শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে লড়তে এবং তাদের শ্রদ্ধা করতে। কার্ল মার্কস বলেছিলেন, শ্রমিকের শ্রম ছাড়া সোনাও মাটি। শিক্ষকই তার শিক্ষার মাধ্যমে একজন ছাত্রকে পূর্ণাঙ্গতা দান করেন। শিক্ষকের আসন শুধু শ্রেণিকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ছড়িয়ে থাকেন বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। শিক্ষক না থাকলে ব্যক্তিজীবন যেমন আলোকিত হয় না, তেমনি সমাজ ও সভ্যতাও আলোকিত হয় না।

শিক্ষক হলেন সমাজের বাতিঘর। এই বাতিঘর যখন অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে উঠতে থাকে, তখন আমরা নিজেরাও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলি। আর এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির প্রভাব পড়ে আমাদের সমাজে এবং এর ভুক্তভোগী আমরাই। শিক্ষক শুধু রুটিরুজির জন্যই শেখাবেন না, তিনি শেখাবেন আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য, আলোর স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এবং নিজের আত্মতৃপ্তি, সমৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা যদি নিজেরা নিজেদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করে তবে সমাজে দৃশ্যমান অনেক বিশৃঙ্খলার সমাধান হয়ে যাবে। তবে এ কথা সত্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া শিক্ষক হওয়া যায় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া শিক্ষকের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় এবং আন্তরিকতা, সদিচ্ছা ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ছাড়া কেউ আদর্শ শিক্ষক হতে পারেন না। যেকোনো মূল্যে আমাদের এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের প্রয়োজনেই। সংকট যত গভীর হয়, শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা তত বৃদ্ধি পায়। সভ্যতার শুরু থেকে আমরা দেখি, শিক্ষকরা নিরলস প্রচেষ্টায় কীভাবে শত প্রতিকূলতা ও বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আবার কতিপয় শিক্ষকের আচরণ দেখে নিজের মধ্যেই প্রশ্ন জাগেÑতারা কীভাবে শিক্ষক, কী কারণে শিক্ষক? তারা না শিক্ষাবান্ধব, না শিক্ষার্থীবান্ধব। তারা প্রাইভেট পড়ানো-বান্ধব, ব্যক্তিবান্ধব, কোচিংবান্ধব ও
শিক্ষার্থী-শোষক। অনেক শিক্ষক কর্তৃত্ব করার নামে শিক্ষার্থীদের শোষণ করেন। আর তাদের কারণেই শিক্ষার্থীরা অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলেন। পরে এই শিক্ষার্থীরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে চরম ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বিরাজ করে। শিক্ষকতা শুধু জীবননির্বাহের জন্য অর্থ উপার্জনের একমাত্র অবলম্বনÑএরকম কেউ ভাবলে তার শিক্ষকতা পেশায় না আসাই উত্তম। এতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যেমন লাভবান হবেন, ঠিক তেমনি দেশ ও জাতিও উপকৃত হবে। শিক্ষকসংকটের কারণেই আজ তরুণসমাজ বিপথগামী। শিক্ষকসংকটের কারণেই আমাদের সমাজ-সভ্যতা ও অর্থনীতি সংকটের মুখে এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উৎপাদন গতিশীল হচ্ছে না। আজকের সমাজে নামধারী শিক্ষকের সংখ্যা অনেক থাকলেও প্রকৃত শিক্ষকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। শিক্ষকসংকট থাকলে সমাজের একশ্রেণির মানুষ খুব বেশি লাভবান হয়। তাদের অন্ধকার রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি পায়। যে শিক্ষক নিজেকেই বিকশিত করতে পারেন না, তিনি অন্যকেও বিকশিত করতে পারেন না। তার শিক্ষায় সমাজে বন্ধ্যাত্ব তৈরি হয়।

তার জন্য শিক্ষকতা নয়, জীবিকার জন্য অন্য কোনো ক্ষেত্রে চেষ্টা করা প্রয়োজন। আজকের সমাজে যে সামাজিক ও মানবিক অবক্ষয় চলছে, সেজন্য নামধারী শিক্ষকের শিক্ষকতা ও শিক্ষাই দায়ী। শুধু শ্রেণিকক্ষে পড়ানোই শিক্ষকের কাজ নয়। ছাত্ররা যখন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রাপ্য সময়টুকু ও প্রত্যাশিত জ্ঞানটুকু না পান, তখন শিক্ষক মর্যাদা হারিয়ে ফেলেন, আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং তার প্রতি ছাত্রদের অবহেলা ও অবজ্ঞা বৃদ্ধি পায়। তবে আজকাল শিক্ষকদের মধ্যেও ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আবার তাদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। একদল শিক্ষককে দেখা যাছে, তার সবকিছু বিকিয়ে দিয়ে শুধু টাকার পেছনে ছুটছেন। ফলে তার ব্যক্তিগত প্রাপ্তি ও সুখ যেমন বিনষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে পারিবারিক অশান্তি ও কলহও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এভাবেই শুরু হয় সামাজিক অধঃপতন ও অবক্ষয়। একজন শিক্ষকের স্বপ্ন তার ছাত্ররা তাকে একদিন অতিক্রম করবে, এটাই স্বাভাবিক। সমাজে এ ধরনের শিক্ষকের বড়ই অভাব। বর্তমান সমাজে শিক্ষকরা গবেষণার চেয়ে ক্ষমতাকেই প্রাধান্য দেন।


এক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষমতা যেখানে মুখ্য হওয়ার কথা ছিল, সেখানে শিক্ষকরা শিক্ষাকে একরকম পরিত্যাগ করে প্রশাসক হওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাচর্চায় নিজেদের যুক্ত করছেন। শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি শিক্ষকদের আগ্রহ কমছে, ক্ষমতার চর্চা বাড়ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা ও উদ্দেশ্যর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ১৯৫২ সালে ইসরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট ওয়াইজম্যানের মৃত্যুর পর বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তার কাছে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির আনন্দের তুলনায় ক্ষমতা মূল্যহীন। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গবেষণাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন। আমাদের শিক্ষকরাও যদি এমন ভাবতে পারতেন, তাহলে হয়তো শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞান অন্বেষণ করা সম্ভব হতো।


শিক্ষক ও শিক্ষার যে সংকট চলছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, শিক্ষকদের সহযোগিতা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। ভালো কাজে ‘হ্যাঁ’ বলুন, খারাপ কাজকে ‘না’ বলুন। আমরা যদি আমাদের সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে চাই, তবে শিক্ষকের পরিসর বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষকরে অবস্থান ফিরিয়ে আনতে দল-মত নির্বিশেষে শিক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, আর তা না হলে শিক্ষার অন্ধকার দশা আরও গভীর হবে। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শিক্ষকদের মধ্যে কোনো শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করা যাবে না। শিক্ষকদের দক্ষতাকে নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।

শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যেও শিক্ষার সংগ্রামকে অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের দেশে শিক্ষকসমাজ যদি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে আন্তরিকতা, একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা ও সততার মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন করত, তাহলে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হতো। সর্বোপরি বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সম্ভব হতোÑশিক্ষকদের অবহেলা করে, তাচ্ছিল্য করে ও লাঞ্ছিত করে সমাজের প্রান্তে ঠেলে দেয়া আর সম্ভব হতো না। আমরা আশা করি, আদর্শ শিক্ষকদের পরিসর বৃদ্ধি পাবে। আমরা ভবিষ্যতে একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গঠন করতে পারব, আলোকিত মানুষ পাব এবং সোনার বাংলাদেশ সোনায় সোনায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০