এম এ খালেক: বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সম্প্রতি ইস্যু করা আমানতের ওপর সুদহার অস্বাভাবিক হ্রাস রোধ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। সার্কুলারে আমানতের ওপর প্রদেয় সুদহারের অস্বাভাবিক নি¤œগামী প্রবণতা রোধের বিষয়ে সক্রিয় থাকার জন্য তফসিলি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে, ব্যাংকগুলোয় আমানতের ওপর সুদ বা মুনাফার হার যেভাবে হ্রাস পাচ্ছে, ঋণের ওপর আরোপিত সুদহার সেভাবে হ্রাস পাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমানতের ওপর সুদহার পাঁচ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। আমানতের ওপর প্রদেয় সুদহার অস্বাভাবিক হ্রাস পাওয়ায় সঞ্চয় প্রবণতা ক্ষুণœ হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সঞ্চয়ের পরিবর্তে অপচয়মূলক ভোগ ও অন্যান্য অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা বাড়তে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সার্কুলার নানা কারণে উল্লেখের দাবি রাখে। কারণ নিকট অতীতে বাংলাদেশ ব্যাংক আর কখনোই এ ধরনের সার্কুলার জারি করেনি। বর্তমানে আমানতের ওপর সুদহার যেভাবে হ্রাস পেয়েছে, তা শুধু বিস্ময়কর নয়, উদ্বেগজনকও বটে। বাংলাদেশ সীমিত পুঁজির একটি দেশ বলা যায়। সাধারণত আমানতকারীরা উচ্চহারে সুদ না পেলে কখনোই ব্যাংকে তাদের পুঁজি সঞ্চিত রাখতে রাজি হন না। ব্যাংকগুলো আমানতের ওপর সুদহার যেভাবে হ্রাস করে চলেছে, তা এটাই প্রমাণ করে যে, প্রতিটি ব্যাংকই এখন উদ্বৃত্ত তারল্য নিয়ে সমস্যায় রয়েছে। অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১২-১৩ সালে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে তীব্র তারল্য সংকট দেখা দিলে ব্যাংকগুলো ১৩-১৪ শতাংশ সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করতে থাকে। অধিকাংশ ব্যাংকই আগ্রাসী ব্যাংকিং শুরু করে। সে অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ করে সার্কুলার জারি করেছিল। কিন্তু কোনো কোনো ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার উপেক্ষা করে আন্ডার হ্যান্ড ডিলিংয়ের মাধ্যমে উচ্চ সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করতে থাকে। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে ব্যাংকগুলো আমানতের ওপর যে সুদ দিচ্ছে, তা ব্যাংক রেটের (কেন্দ্রীয় ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে সুদ চার্জ করে) চেয়েও কম। অনেক দিন ধরে ব্যাংক রেট পাঁচ শতাংশে সীমিত রয়েছে। বর্তমানে তফসিলি ব্যাংকগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমানতকারীদের পাঁচ শতাংশের কম সুদ দিচ্ছে। ফলে আমানতকারীরা তুলনামূলক কম মুনাফা বা সুদ পাওয়ার কারণে ব্যাংকে টাকা রাখতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেÑএটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তারা অপ্রয়োজনীয় ভোগ ব্যয়ে এ অর্থ ব্যয় করতে পারে। এছাড়া তারা নন-ব্যাংক খাতে অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহী হতে পারে।
যেহেতু ব্যাংকিং সেক্টরে আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার অস্বাভাবিক কমে গেছে, তাই এ অবস্থা দেশের অর্থনীতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। উল্লেখ্য, আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হারের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কী পরিমাণ সুদ চার্জ করবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, ঋণ ও আমানতের ওপর কত হারে সুদ দেওয়া হবে, তা বাজার চাহিদার ওপর নির্ভর করে। বর্তমানে আমানতের ওপর সুদহার সাম্প্রতিক সময়ে সর্বনি¤œ পর্যায়ে রয়েছে। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই ঋণের ওপর সুদহার যৌক্তিকভাবে কমে আসার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এর নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত ব্যাংক মালিকরা, বিশেষ করে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের মালিকরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঋণের সুদহার নিয়ন্ত্রণ করছেন। ফলে আমানতের ওপর প্রদত্ত সুদের হার কমলেও তার প্রভাব ব্যাংক ঋণের সুদের ওপর পড়ছে না। এখনও ব্যাংকগুলো ১১-১২ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। অর্থাৎ ব্যাংকের স্প্রেড দাঁড়াচ্ছে ৬-৭ শতাংশ। অথচ বর্তমান অবস্থায় ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসার কথা। বাংলাদেশ ব্যাংক স্প্রেডের হার পাঁচ শতাংশে নির্ধারণ করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের
নির্দেশনা হচ্ছে উপেক্ষিত।
ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণ ও আমানতের চাহিদা অস্বাভাবিক কমে গেছে। প্রায় প্রতিটি ব্যাংকই বিনিয়োগযোগ্য বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য নিয়ে বসে আছে; কিন্তু উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বিনিয়োগ চাহিদায় বিরাজ করছে মন্দাভাব। এখন আমানতের ওপর প্রদেয় সুদহার অস্বাভাবিক কমে গেলেও ঋণের সুদহার না কমার পেছনে কিছু বিশেষ কারণ রয়েছে। অবলোপন করা ঋণসহ ব্যাংকিং সেক্টরে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা। এ বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণের জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এছাড়া ইতোপূর্বে যাদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে, তাদের নিয়মিত সুদ দিতে হচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংকের নিট মুনাফার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তবে সাধারণভাবে আমানতের ওপর প্রদেয় সুদহার কমলে ঋণের ওপর আরোপিত সুদহার এমনিতেই কমে আসার কথা; কিন্তু আমাদের দেশে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটছে।
বর্তমানে আমানতের ওপর সুদহার যেভাবে কমে গেছে, তা দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য মোটেও মঙ্গলজনক নয়। কারণ এতে শুধু ব্যাংকিং সেক্টর নয়, পুরো অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ইস্যু করা সার্কুলারে এর কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু অবস্থা তার চেয়ে মারাত্মক হতে পারে। এ অবস্থায় আমানতকারীরা সঞ্চয়পত্র কেনার দিকে আরও বেশি মনোযোগী হতে পারেন। উদ্বৃত্ত পুুঁজির মালিকরা অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় বাড়িয়ে দিতে পারেন। অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে মুদ্রা পাচারের বিষয়টি। যাদের হাতে প্রচুর উদ্বৃত্ত অর্থ আছে, তারা এগুলো স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগের সুযোগ না পেয়ে দেশের বাইরে পাচার করে দিতে পারেন। কারণ উদ্বৃত্ত পুঁজির মালিকরা তাদের টাকা নিজেদের কাছে গচ্ছিত রাখাটা কোনোভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করবেন না। সামাজিক অস্থিরতার কারণে ব্যক্তিগতভাবে টাকা বিনিয়োগ করলে তা আবার ফেরত আসার ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা থাকবে না। উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে শিল্প-কারখানা স্থাপন করবেন, তেমন অবস্থাও বর্তমানে নেই। এ অবস্থায় তারা উদ্বৃত্ত টাকা স্থানীয়ভাবে মহাজনি ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারেন। সেটাও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া এ অর্থ নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজে ব্যবহƒত হতে পারে। বিশেষ করে, চোরাচালান বা এ ধরনের অবৈধ কাজে বিনিয়োগ বেড়ে যেতে পারে। উদ্বৃত্ত পুঁজির মালিকরা তাদের অর্থ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে পারেন। কিন্তু সে অবস্থায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এনজিওগুলো যদি তুলনামূলক স্বল্প সুদে এ অর্থ সংগ্রহ করে সাধারণ মানুষের কাছে বিনিয়োগ করে, তাহলে তারা ঋণের ওপর সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ হারে সুদারোপ করতে পারবে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এনজিওগুলোর তৎপরতা আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কোনো কারণে একবার যদি এনজিওদের কাছে এ অর্থ চলে যায়, তাহলে পুনরায় তা ব্যাংকিং চ্যানেলে নিয়ে আসাটা খুব কঠিন হবে। তাই উদ্বৃত্ত বিনিয়োগযোগ্য তহবিল যাতে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চলে না যায়, তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
বস্তুত কোনো আইন বা সার্কুলার দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। অর্থনীতির স্বাভাবিক সূত্র দিয়েই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। আমানতের ওপর প্রদেয় সুদহার বাড়ানোর জন্য প্রথমেই বিনিয়োগ চাহিদা বাড়াতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিদেশি সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তারা সাধারণত স্বল্প সুদের কারণে বিদেশি সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণে আগ্রহী। এছাড়া বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে ঝামেলাও কম। স্থানীয় ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এগুলো দূর করতে হবে। বর্তমানে যেহেতু আমানতের ওপর সুদহার অনেকটাই কমে গেছে, তাই এ সুযোগে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা যেতে পারে। স্থানীয় উদ্যোক্তারা দেশীয় ব্যাংক থেকে যদি তুলনামূলক স্বল্প সুদে হয়রানিমুক্তভাবে ঋণ গ্রহণ করতে পারে, তাহলে তারা বিদেশি সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণে আগ্রহী হবেন না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যাংক ঋণের সুদহার ও আমানতের ওপর প্রদেয় সুদহার নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তেমন কোনো ভূমিকা থাকা উচিত নয়। তবে কোনো অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে পারে। বর্তমানে ঋণের সুদহার এবং আমানতের ওপর প্রদেয় সুদহার নিয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংকিং সেক্টর বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের ওপর সুদহার কমানোর জন্য তফসিলি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিতে পারে। প্রয়োজনে এখনই ব্যাংক রেট কিছুটা কমানো যেতে পারে। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান পর্বতপ্রমাণ খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। বেসরকারি ব্যাংকগুলো যাতে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে ঋণের সুদহার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সুদের হার কমানোর পাশাপাশি আমানতকারীদের যাতে যৌক্তিকভাবে সুদ দেওয়া হয়, তাও দেখতে হবে। এ মুহূর্তে বিনিয়োগ চাহিদা বাড়ানোর কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না।
অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক
Add Comment