Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 10:15 pm

আমানত কমলেও বাড়ছে ঋণের পরিমাণ

শেখ আবু তালেব: দেড় বছরের অধিক সময় ধরেই করোনার আঘাতে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। এতে কমেছে সিংহভাগ মানুষের আয়। বিশেষ করে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সঞ্চয় ভেঙে জীবন নির্বাহ করছেন। ফলে দেশের ব্যাংকের পাশাপশি আর্থিক খাতেও কমেছে এ শ্রেণির আমানত। কিন্তু সুদহার ব্যাংকের তুলনায় বেশি হওয়ায় বেড়েছে উচ্চ তথা বড় আমানতকারীদের জমানো টাকার অঙ্ক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) আমানত কমেছে। গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকেই আমানত কমেছে ৫৬৩ কোটি টাকা। এই সময়ে অবশ্য ঋণ বেড়েছে ৬১৪ কোটি টাকা।

তথ্য বলছে, গত মার্চ শেষে দেশের এনবিএফআইগুলোতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ২৩২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর মধ্যে সাধারণ সঞ্চয়ের পরিমাণ হচ্ছে ১৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ বা ২২০ কোটি টাকা, ফিক্সড ডিপোজিটের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ১৭৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, যা মোট আমানতের ৯৭ দশমিক ৬১ শতাংশ।

এর আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ গত ডিসেম্বর শেষে ফিক্সড ডিপোজিটের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৭১০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। তিন থেকে ছয় মাসের ব্যবধানে জমানো টাকা ভাঙানোর পরিমাণ হচ্ছে ৫৩৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত ৯ মাসে সঞ্চয় চলে গেছে এ খাত থেকে চলে গেছে ৪৪৮ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আমানতের শ্রেণিবিভাগ করে দেখা গেছে, মোট আমানতের মধ্যে ফিক্সড ডিপোজিটের অনুপাত বেড়েছে পূর্বের চেয়ে। গত ডিসেম্বর শেষে মোট আমানতের ৯৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ ছিল। গত মার্চ শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৯৭ দশমিক ৬১ শতাংশে। অর্থাৎ দীর্ঘ মেয়াদে সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়িয়েছে অনেকেই।

সূত্র জানিয়েছে, মূলত স্বল্প অঙ্কের আমানতধারীরা জীবন বাঁচাতে অর্থ তুলে নিয়েছেন। অপরদিকে বড় অঙ্কের আমানতকারীরা তাদের জমানোর পরিমাণ বাড়িয়েছেন। এজন্য মোট আমানতে ফিক্সড ডিপোজিটধারীদের অংশ বা অনুপাত বেড়েছে পূর্বের চেয়ে।

কারণ হিসেবে দেশের প্রথম সারির একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সব সময় ব্যাংকের চেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুদের হার বেশি থাকে। কারণ হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ ছাড়করণ প্রক্রিয়া ব্যাংকের তুলনায় অনেক কম সময় নেয়। এখানে গ্রাহকরা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ঋণের অর্থ পেয়ে যান। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারের সঙ্গে হালনাগাদ তথ্য রাখেন সবার। এজন্য কোনো গ্রাহক নির্বাচনে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়। আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প সময়ের জন্য আমানত নেয় না। এজন্য ব্যাংকের কাছ থেকেও আমানত নিতে হয়। এতে খরচ বাড়ে। বর্তমানে ব্যাংকে আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ। সেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদহার ৯ শতাংশ পর্যন্ত আছে। এজন্য অনেকেই এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানমুখী হচ্ছেন বেশি সুদের আশায়। সক্ষমতা থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতও নিচ্ছে। কারণ দু’একটি বাদে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সূচকগুলো ভালো অবস্থানেই আছে। এজন্য দেখবেন ঋণ বিতরণ কিন্তু প্রবৃদ্ধিতেই রয়েছে আর্থিক খাতে।’

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ ও আগাম দেয়ার স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৯১৪ কোটি ২১ লাখ টাকা। গত ডিসেম্বরে যা ছিল ৭০ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে ঋণ দেয়া বেড়েছে ৬১৪ কোটি টাকার ওপরে।

তথ্য বলছে, বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে সর্বোচ্চ গিয়েছে শিল্প খাতে ৩২ দশমিক ১৩ শতাংশ বা ১৮ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। এছাড়া মৎস্য খাতে ৪১৫ কোটি, নির্মাণে ৪৪০ কোটি, পরিবহনে ৮৭৩ কোটি, ট্রেডিংয়ে এক হাজার ৩৬৮ কোটি, ভোক্তা ঋণে এক হাজার ১২২ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসের ব্যবধানে সবচেয়ে ঋণ কমেছে পরিবহন খাতে। এ খাতে ঋণের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে।

প্রসঙ্গত, ব্যাংকগুলো বিভিন্ন মেয়াদে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করতে পারলেও এনবিএফআইগুলো তা পারে না। বিদ্যমান নিয়মে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তিন মাসের কম মেয়াদের জন্য কোনো আমানত নিতে পারে না। ফলে গ্রাহকের কাছ থেকে সরাসরি আমানত সংগ্রহের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকেই তুলনামূলক বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করে থাকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। আর ব্যাংকের চেয়ে বেশি সুদে ঋণ বিতরণ করে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে প্রতিষ্ঠানের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় ব্যাংকের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি হয় সব সময়।

বর্তমানে দেশি-বিদেশি ও রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি মিলিয়ে অনুমোদিত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) রয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে ২৩টি দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।