কাজী সালমা সুলতানা: বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে কয়েক বছর ধরে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ দিবসটি ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৪৭ সালে সাংগঠনিকভাবে ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১১ মার্চ ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘটকে সফল করতে আন্দোলনকারীদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়। ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় আবার ধর্মঘট সফল হওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই ধর্মঘট ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় হওয়ার কথা থাকলেও ক্রমেই তা পূর্ব বাংলাব্যাপী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পালন করা হয়। সেদিন ধর্মঘট পালনকালে নিরাপত্তা আইনে শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শামসুল হক, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ নেতা এবং বহু ছাত্রছাত্রীকে আটক করা হয়। পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে তাড়া ও মারপিট শুরু হয়ে গেলে ধর্মঘটে ছাত্রদের পক্ষে কিছু সেক্রেটারিয়েট ও রেল কর্মচারী যোগদান করেন। ঢাকায় কিছু সময়ের জন্য রেল ধর্মঘটও হয়। জায়গায় জায়গায় ছাত্রদের ওপর চরম পুলিশি নির্যাতন শুরু হয়।
কামরুদ্দিন আহমেদ তার প্রবন্ধে বলেনÑঐতিহাসিক ১১ মার্চ। দিকে দিকে চলল নওজওয়ানের কুচকাওয়াজ। সুদূর মফস্বল থেকে ছাত্ররা এলেন তাদের মাতৃভাষার দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে। শত-সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হলো ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ঢাকার খাজা পরিবারের হামিদুল হক চৌধুরী ও ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) পণ করলেন এই আন্দোলন বন্ধ করার জন্য। ঢাকা শহরবাসীকে ভুল বোঝানো হলো। ভারাটিয়া গুণ্ডা লেলিয়ে দেওয়া হলো। তারা গোটা ছাত্রসমাজ ও বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে। শহরবাসীর পক্ষ থেকে ঢাকা সেন্ট্রাল ক্লাবস কমিটির সম্পাদক ও কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে জনাব কমরুদ্দীন একটি চুক্তিও সম্পাদন করেন। তাতে গুণ্ডামির মাত্রা কমে গেল, কিন্তু সম্পূর্ণ শেষ হলো না। জাগ্রত যুব ও ছাত্রসমাজ এগিয়ে চলল। সেদিনের আন্দোলন ঢাকা থেকে বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চাঁদপুর, জামালপুর, ভৈরব, খুলনা, চট্টগ্রাম, ঢাকার অদূরে মতলব, মেহেরপুর, পাবনাসহ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয়েছিল এসব জায়গা থেকে। রাজশাহীতে সেদিন মিছিল-মিটিংয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন আবুল কাশেম চৌধুরী, একরামুল হক, গোলাম রহমান প্রমুখ ছাত্র নেতা। রাজশাহী বিভাগ জুড়ে এই আন্দোলন প্রবল জোয়াড় সৃষ্টি করে। রাজশাহীতে এই আন্দোলন চলাকালে মারাত্মকভাবে নির্যাতনের শিকার হন গোলাম তাওয়াব। বগুড়ায় প্রতিবাদ মিছিলের নেতৃত্ব দেন স্বয়ং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি তখন বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষ। তার নেতৃত্বে এই প্রতিবাদ সভা পুরো জেলাতেই ছড়িয়ে পরে।
১২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ ১১ মার্চে সংগঠিত নির্যাতন-জুলুমের প্রতিবাদ করেন। এক বিবৃতির মাধ্যমে তিনি পূর্ব বাংলার সব ছাত্রছাত্রীকে ভাষা আন্দোলনে যোগদানের আহ্বান জানান। এই বিবৃতির হিসাবমতো ১১ মার্চে আন্দোলনে আহত হন ২০০ জন। তার মধ্যে ছিলেন গুরুতর আহত ১৮ জন ও ধৃত ৯০০ জন, যার মধ্যে অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়। জেলবন্দি হন ৬৯ জন।
১৯৪৮ সালের এপ্রিলের পর থেকে ছাত্রদের এই আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। তবে ছাত্ররা প্রতিবছর ১১ মার্চ দিবস পালন করে আসছিলেন।
(সূত্র: বাংলা ভাষা আন্দোলন, বশির আল হেলাল)