কাজী সালমা সুলতানা: ভারত ভাগের পরই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে ভাষাসহ অন্যান্য বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে ১৯৪৭ সালে কলকাতার সিরাজ-উদ-দৌলা হোটেলে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা বৈঠকে বসেন। শেখ মুজিবুর রহমানও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। সভায় পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত কর্মিসম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। এ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত পাঠ করেন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। প্রস্তাবে বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা এবং সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, সে সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
১৯৪৭ সালেই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। এ বছরের ডিসেম্বর মাসে রাজনীতিবিদসহ ১৪ ভাষাবীর ভাষা-আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবিসংবলিত ‘রাষ্ট্রভাষা: ২১ দফা ইস্তেহার: ঐতিহাসিক দলিল’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এই ২১ দফার মধ্যে দ্বিতীয় দাবি ছিল রাষ্ট্রভাষার। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ১০ দফার মধ্যে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত গণপরিষদ অধিবেশনের সব কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুতে করার পাশাপাশি বাংলাতেও রাখা এবং বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তোলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই দাবি নাকচ করে দেন।
১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ভাষার প্রশ্নে ধর্মঘট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তমদ্দুন মজলিস প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম হরতাল। হরতালে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে পুলিশ নির্যাতন ও গ্রেফতার করে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম কারাবরণ। এ বছরের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং শেখ মুজিবসহ ভাষাসৈনিকরা কারামুক্ত হন।
ধারাবাহিক কর্মসূচিতে ভাষা আন্দোলন ধাপে ধাপে এগিয়ে যায়। এ দেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা আন্দোলনে শরিক হয়। আসে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ নাম না জানা শহীদরা বুকের রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেন। তাদের সেই ত্যাগের ক্ষণভিত্তিক সম্মান জানানো হলেও এখনও বাংলা ভাষার যথাযথ মর্যাদা দেওয়া যায়নি। ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত নারী বীরদের নাম আজও অজানাই রয়ে গেছে বলা যায়।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পর ৬৮ বছর পেরিয়ে গেছে। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী দ্বারপ্রান্তে; কিন্তু বাংলা ভাষার দুর্দিন আজও কাটেনি, ভাষাশহীদদের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। তারপরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। অফিস-আদালত থেকে শুরু করে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার আইন পাস হয়েছে। তারপরও অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ৮০ ভাগও চালু হয়নি। বেসরকারি অফিসে বাংলা ভাষার অবস্থা আরও দুঃখজনক।
ভাষার প্রশ্নে রক্ত দেওয়ার মতো নজিরবিহীন ইতিহাস রচনাকারী দেশে মাতৃভাষায় শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। গণমাধ্যমসহ সর্বস্তরে বাংলার প্রমিত ব্যবহার চালু হয়নি। বরং গণমাধ্যমে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা লক্ষণীয়। আন্তর্জাতিকতার নামে দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতে বাংলা ভাষাকে পেছনে ফেলে রাখা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বাংলার সঠিক ব্যবহার রীতি শেখানো হয় না। ফলে বাংলা ভাষার উৎকর্ষ কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে না। অথচ উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হচ্ছে মাতৃভাষায় শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো মাতৃভাষায় শিক্ষার মাধ্যমেই এগিয়ে গেছে।
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি শেষ হলেই আমরা যেন স্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাই! সেই অবস্থার অবসান প্রয়োজন। প্রয়োজন পাঠ্যপুস্তকে বাংলা ভাষার সঠিক রীতি যুক্ত করা এবং শিক্ষা দেওয়া। বিশ্বায়নের সঙ্গে এগিয়ে যেতে প্রয়োজন অনুবাদ ব্যবস্থাকে জোরদার করে মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা। তাহলেই কেবল ভাষাশহীদ ও মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা হবে, জাতি হিসেবেও আমার দ্রুত সমৃদ্ধির শিখরে উঠতে পারব।