Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:35 am

আমার শৈশব, আমার অধিকার

কাজী শাম্মীনাজ আলম: রাজশাহীর সাবিনা, অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত বয়স আনুমানিক ১৪ হবে। স্বপ্ন তার লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। একটা ভালো চাকরি করবে। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। দিনমজুর বাবা কাজ হারিয়ে সংসারের চাহিদা মেটাতে অক্ষম হয়ে পড়েন। খরচের দায়মুক্তির জন্য তিনি অপ্রাপ্ত বয়স্ক সাবিনার বিয়ে দিয়ে দেন।

প্রাচীনকাল থেকে মেয়েদের ‘পরিবারের বোঝা’ মনে করার মানসিকতা এখনও বিদ্যমান। তারই প্রতিফলন সাবিনা। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির বিয়ে মানেই বাল্যবিবাহ। এই উপমহাদেশে বাল্যবিয়ের প্রথা প্রচলিত আছে এক হাজার বছর পূর্ব থেকে। তবে এটি প্রশ্নবিদ্ধ হয় বিংশ শতাব্দীর দিকে, যখন বিভিন্ন দেশে বিয়ের সর্বনি¤œ বয়স বৃদ্ধি পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী বর্তমানে জীবিত ৬৫ কোটি নারীর বিয়ে হয়েছিল শৈশবে। এর প্রায় অর্ধেক ঘটেছে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, ইথিওপিয়া, ভারত ও নাইজেরিয়ায়। হতাশার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ বাল্যবিয়ের উচ্চহারে বিশ্বে চতুর্থ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় এক নম্বর দেশ।

ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিশু বিয়ের প্রবণতা ১৯৭০ সালের তুলনায় ৯০ শতাংশের বেশি কমেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টায় দেশে বাল্যবিয়ের হার হ্রাস পেলেও করোনাকালে আর্থসামাজিক বিপর্যয়ের কারণে শিশু বিয়ে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সাম্প্রতিক এ প্রবণতা আরও উদ্বেগজনক। দারিদ্র্যপীড়িত ও প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে করোনাকালে পরিবারে মেয়েশিশুদের দেখা হয়েছে বোঝা হিসেবে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, দেশে বাল্যবিয়ের হার ছিল ৩৩ শতাংশ। কিন্তু সম্প্রতি ব্র্যাকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে জরিপকৃত কিছু এলাকায় করোনাকালে বাল্যবিবাহ ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গত ২৫ বছরে দেশে বাল্যবিবাহের সর্বোচ্চ হার। ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ২০২০ সালে মার্চে কভিড-১৯ শুরুর প্রথম সাত মাসে দেশের ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় প্রায় ১৪ হাজার বাল্যবিবাহ সংঘটিত হয়েছে, যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত চাইল্ড হেল্পলাইন-১০৯৮-এর তথ্যমতে, করোনাকালে বাল্যবিবাহ সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯সহ অন্য নম্বরগুলোয় বাল্যবিয়ের ঘটনার ফোনকলের সংখ্যা বেড়েছে। রাজশাহী জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, রাজশাহীতে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার ৫১২ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। বিগত দশকে বাল্যবিয়ে রোধে সরকারের সব অর্জনকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করার হুমকিতে ফেলছে করোনাকালে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির  এই উচ্চহার।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় বাল্যবিয়ের একটি অন্যতম কারণ পরিবার ও সমাজে নারী-পুরুষের ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাল্যবিয়ের মাধ্যমে নারী-পুরুষের অসমতাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বাংলাদেশেও পরিবারগুলোতে ছেলেমেয়েরা ভিন্ন ভিন্নভাবে বেড়ে ওঠে। পরিবার, সমাজ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা ভিন্ন ভিন্ন সুযোগ-সুবিধা লাভ করে, ভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হয়। ছেলেসন্তানের মাধ্যমে বংশ এবং সম্পদ রক্ষা হয় এবং মেয়েদের বিবাহের উপযুক্ত করে তৈরি করা হয়। করোনা পরিস্থিতি এই বাঁধাধরা চিন্তার রসদ হিসেবে কাজ করেছে। আয়ের উৎস বন্ধ বা সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় এবং এই সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কায় মা-বাবাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে দেয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রামীণ পরিবারগুলো মেয়েদের শিক্ষাজীবন প্রলম্বিত না করতে এবং ভারমুক্ত ও নিশ্চিন্ত থাকতে অনেক অভিভাবক কমবয়সী মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। করোনার জন্য সমাগম করে সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় অনেকেই ঘরোয়াভাবে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করছেন। ফলে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে প্রশাসনের নজরদারি এড়ানো সম্ভব হচ্ছে। লকডাউনে নিকটাত্মীয়দের দ্বারা মেয়েশিশুদের যৌন হয়রানির ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক অভিভাবক মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, অভিবাসী শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিরা করোনাকালে দেশে ফিরেছেন। ‘পাত্র’ হিসেবে প্রবাসীদের চাহিদা বেশি বলে কন্যাশিশুদের অভিভাবকরা বিয়ে দিচ্ছেন। যার ফলে করোনায় বাল্যবিয়ে ‘নয়া মহামারি’ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বাল্যবিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম অন্তরায় এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়, যা তাদের অর্থনৈতিক মুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করে এবং পরিবারে পুরুষের সঙ্গে তাদের অসম অবস্থান তৈরি হয়। এর ফলে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয় তারা। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় অনেক বিষয়ে মেয়েদের সচেতনতার অভাব দেখা যায়। মেয়েরা কমবয়সে গর্ভধারণ করে ফলে সন্তান জš§দানে জটিলতা সৃষ্টি হয়। বাল্যবিয়ে মাতৃস্বাস্থ্য ছাড়া শিশুস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এতে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের অপরিণত সন্তান বা কম ওজনের সন্তান জš§দানের সম্ভাবনা ৩৫-৫৫ শতাংশ এবং শিশুমৃত্যুহার ৬০ শতাংশ। কমবয়সী নারীর গর্ভজাত শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই দুর্বল ও বেশিরভাগ শিশুই অপুষ্টিতে ভোগে; যা যেকোনো দেশের উন্নতির অগ্রগতিকে ব্যাহত করে। বাল্যবিয়ে মেয়েদের মেধা ও সম্ভাবনাকে অকেজো করে দেয়, ফলে দেশ একটি মেধাবী প্রজন্ম থেকে বঞ্চিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত বাল্যবিবাহবিষয়ক বৈশ্বিক সম্মেলনে অঙ্গীকার করেন, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে মেয়েদের বিবাহ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সব ধরনের বাল্যবিবাহ বন্ধ হবে। সে লক্ষ্যে সরকার বাল্যবিয়ে রোধে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সফলতা অর্জন করেছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ও নারী উন্নয়নে বিভিন্ন আইন, বিধি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিগুলো বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছে। বাল্যবিবাহ ও যৌতুক প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রান্তিক ও অসহায় কিশোর-কিশোরীদের জেন্ডার বেইজড লেন্স প্রতিরোধ করার জন্য ৮ হাজার কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থাপন করা হয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য ১ কোটি মহিলাকে তথ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারের আরেকটি সময়োপযোগী উদ্যোগ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংসদে পাস হওয়া ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭’। এ আইন পাসের ফলে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট-১৯২৯’ বাতিল হয়ে যায়। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ পাসের আগে বাল্যবিবাহ রোধে, ব্রিটিশ সরকার প্রণীত ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট-১৯২৯’ ছিল, যাতে বলা হয়েছিল কোনো নারী ১৮ বছরের আগে এবং কোনো পুরুষ ২১ বছরের আগে যদি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই শাস্তির সময়কাল এবং অর্থদণ্ড বর্তমান সময়ের সাপেক্ষে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম ছিল, ফলে এই আইনটি অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। ২০১৭ সালে প্রণীত বর্তমান আইনে বয়সের সীমা একই রেখে, শাস্তির সময়কাল এবং অর্থদণ্ডের পরিমাণ সর্বোচ্চ দুই বছর এবং এক লাখ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন আইনে শাস্তির আওতায় কারা আসবে তার পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যারা বিয়ে পরিচালনা করেন এবং বিয়ে রেজিস্ট্রি করেন, তাদের ও শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। অর্থাৎ শুধু অপ্রাপ্তবয়স্ক বর, কনে বা তাদের পরিবারসংশ্লিষ্ট সবাই আইন ভঙ্গের শাস্তি পাবে। নতুন আইনের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, প্রমাণক প্রদর্শনের জন্য বয়স নির্ধারণকারী সনদগুলো ‘নির্দিষ্ট’।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে পরিচালিত শেখ হাসিনার সরকার নারীর ক্ষমতায়নে যে কোনো সিদ্ধান্ত ও গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নে আপসহীন। বাল্যবিয়ের অবসান ঘটানো নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। বাল্যবিয়ে রোধে অনেক বছর ধরেই সরকার সচেষ্ট। কিন্তু করোনা মহামারিতে সময়োপযোগী, সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন, যা বাল্যবিয়ে রোধে সাম্প্রতিক অগ্রগতিতে আরও বেগবান করতে পারে। এছাড়া প্রয়োজন সরকার ও সিভিল সোসাইটি এবং বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে সুসমন্বয়। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও সমাজের অগ্রসর নাগরিকদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বাল্যবিয়ে রোধে কাজ করতে হবে। তবে সবার আগে বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক ব্যাধি নির্মূলে নারীর প্রতি সমাজের প্রতিটি স্তরে অসম ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তবেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বৈষম্যমুক্ত, মর্যাদাপূর্ণ ও অধিকারভিত্তিক ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। পিআইডি নিবন্ধন