প্রতিনিধি, যশোর: ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে গোটা যশোর। এমন দীর্ঘস্থায়ী ঝড় এর আগে দেখেনি যশোরের মানুষ। ঝড়ের তাণ্ডবে জেলায় ছয়জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। হতাহতের পাশাপাশি মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, গাছপালা সব ধ্বংস দেয় আম্পান। মাছ, সবজি, আম, লিচু, পানের বরজসহ কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়। তারের ওপর গাছ আছড়ে পড়ে পুরো জেলা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ধ্বংসলীলা চালানোর পর বুধবার বিকালে প্রলয়ংকরী আম্পান আছড়ে পড়ে সাতক্ষীরা উপক‚লবর্তী এলাকায়। এর পর থেকেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলার আবহাওয়া চরম ভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। এর বড় প্রভাব পড়ে যশোর জেলায়। এর আগে দুপুরের পর থেকে এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। সময় যত বাড়তে থাকে বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসের তীব্রতাও ঠিক তেমনি বাড়তে থাকে।
বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিট থেকে শুরু হয় আম্পানের প্রভাবে ঝড় ও বৃষ্টি। রাত ১০টা থেকে এর তীব্রতা বাড়তে থাকে। যশোর বিমানবন্দর-নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া অফিস থেকে জানা যায়, ১০টায় ঝড়ের গতিবেগ ছিল প্রতি ঘণ্টায় ১০৪ কিলোমিটার, রাত ১২টায় তীব্রতা বেড়ে হয় ১৩৫ কিলোমিটার।

রাত পৌনে ২টায় ঝড়ের গতিবেগ কিছুটা স্তিমিত হয়, কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালেও ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে চলে মৃদু বৃষ্টি। ঝড়ের এ তীব্রতায় গোটা জেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভুক্তভোগীরা বলেন, সিডর, বুলবুলসহ বাংলাদেশে প্রলয়ঙ্করী যে কয়টি ঝড় হয়েছে, তার প্রভাবও যশোরে এমন পড়েনি যেমনটা আম্পান দেখিয়েছে।
এদিকে সাইক্লোন আম্পানের তাণ্ডবে যশোরে ছয়জন নিহত হওয়ার খবর বুধবার বিকালে সাংবাদিকদের কাছে নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক শফিউল আরিফ। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন শার্শা উপজেলায় তিনজন, চৌগাছা উপজেলায় দুজন ও বাঘারপাড়া উপজেলায় একজন। ঘরে গাছ পড়ে তারা মারা যান। নিহতদের পরিবারের প্রত্যেককে যশোর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
নিহতরা হলেন শার্শায় ময়না খাতুন, মুক্তার আলী ও গোলাপ চন্দ্র বিশ্বাস, চৌগাছা উপজেলায় খ্যান্ত বেগম ও তার মেয়ে রাবেয়া এবং বাঘারপাড়া উপজেলার ডলি খাতুন। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় অর্ধশত মানুষ আহত হয়েছেন। এর মধ্যে যশোর সদর হাসপাতাল থেকে তিন শিশুসহ চিকিৎসা নিয়েছেন ১৯ জন।
ঝড়ে হতাহতের পাশাপাশি ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, মাত্র কয়েক দিন আগেই জেলার বোরো আবাদ ঘরে তুলেছেন কৃষক। এ কারণে বোরো ধানের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে সবজি, পাট, পান, আম, লিচুসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. আকতারুজ্জামান বলেন, দীর্ঘস্থায়ী ঝড়ের কারণে যশোরের ফসলের ক্ষতি বেশি হয়েছে। তিনি বলেন, এর আগে এ অঞ্চলে ঝড় বয়ে গেলেও এত সময় আর চলেনি, যে কারণে ক্ষতি হয়েছে বেশি। তিনি বলেন, এরই মধ্যে আমরা জেলার ক্ষতির বিষয়টি চিহ্নিত করেছি এবং এর পুরো তথ্য কৃষি মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে রয়েছে ১১ হাজার ৭৮৩ হেক্টর জমির পাট, ১১ হাজার ৭৪৮ হেক্টর জমির সবজি যা মোট আবাদের ৮০ শতাংশ, ৭৫০ হেক্টর পেঁপে, এক হাজার ৫০০ হেক্টর কলা, ৬৭৫ হেক্টর মরিচ, এক হাজার ৪৫ হেক্টর মুলা, তিন হাজার ৩৯৫ হেক্টর আম, ৬০০ হেক্টর লিচু ও এক হাজার হেক্টর জমির পান। এসব ফসলের মোট ৭০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তিনি জানান।

এছাড়া জেলার নিম্নাঞ্চল কেশবপুর-মনিরামপুরের ভবদহ এলাকায় পানিতে তলিয়ে গেছে শত শত হেক্টর জমির ফসল। ভেসে গেছে ঘেরের মাছ। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেন, ঝড়ের সঙ্গে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে যশোরের কেশবপুর, মনিরামপুরের নিম্নাঞ্চলের কিছু ঘের ও পুকুর ভেসে গেছে। তবে অন্যান্য এলাকায় মাছের তেমন ক্ষতি হয়নি।
আম্পানের কারণে গাছপালা ভেঙে জেলার অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যশোর-বেনাপোল সড়কের শতবর্ষী প্রাচীন গাছগুলো ভেঙে রাস্তার ওপর পড়ায় দুপুর পর্যন্ত ওই সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। এছাড়া যশোর-খুলনা মহাসড়ক, যশোর-মাগুরা সড়ক, ঝিনাইদহ সড়কসহ অধিকাংশ সড়কের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ফায়ার ডিফেন্সের কর্মীরা এসব গাছ সরিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করেন।
এছাড়া ঝড়ে বিদ্যুতের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বিদ্যুতের তারের ওপর গাছ ও ডাল ভেঙে পড়ায় গোটা জেলা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন থাকার পর কিছু এলাকায় সংযোগ দেওয়া হলেও এখনও দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
জেলা প্রশাসক শফিউল আরিফ জানান, গোটা জেলার ক্ষতি এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। কাজ চলছে। তবে ঘরবাড়ি ও গাছ ভেঙে মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, ঝড়ের কারণে যেসব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের তালিকা প্রস্তুতির কাজ করা হচ্ছে। তালিকা প্রস্তুত শেষে এসব মানুষকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হবে।