Print Date & Time : 27 June 2025 Friday 1:33 pm

আম্বানির পুনরুত্থান

শামসুন নাহার: রাজীবের অর্থমন্ত্রী ভিপি সিংয়ের আঘাতে যতই ধাক্কা লাগুক না কেন, ওপরে ওপরে ভাবমূর্তি ঠিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন আম্বানি। গণমাধ্যমে প্রচার করেছেন যে, তদন্তের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না। তিনি তার মতো করে ব্যবসা করে গেছেন। সরকারি পলিসির সঙ্গে সমন্বয় রেখে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সরকারের সিদ্ধান্ত ফাঁস করার চেষ্টাও করেননি তিনি। গ্রেস পিরিয়ডের আগে ২৭ মে ৫০ হাজার টনের যে আমদানি চুক্তিটির অনুমোদন দেয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়, সেটি মূলত জমা দেওয়া হয়েছিল ১৪ মে। তিন দিনের মধ্যে অনুমোদন করানো গুজব ছাড়া কিছু নয়। তাছাড়া মে মাসে ঘটা করে পিটিএর বড় মাপের আমদানির পেছনে বিশেষ কারণ রয়েছে। রিলায়ান্স নিজেই পিটিএ প্লান্ট স্থাপন করতে যাচ্ছে। এ প্লান্ট হতে আর ১৮ মাসের মতো সময় লাগবে। সে পর্যন্ত পিটিএর মজুত ঠিক রাখতেই এখন বেশি পরিমাণে আমদানি করে রাখা হচ্ছে। তবে পরেও হয়তো করা যেত। কিন্তু পরবর্তী সেপ্টেম্বরেই শুল্কের পরিমাণ আবারও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় ঝুঁকি নিতে চায়নি রিলায়ান্স। আম্বানি আরও জোর দিয়ে বলেন, রিলায়ান্স অসাধু প্রোপাগান্ডার শিকার হয়েছে। কাদের স্বার্থে এ কাজ করা হচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এরপর ২৯ অক্টোবর রিলায়ান্সের ওপর নেমে এলো আরেক ভয়াবহ আঘাত। কেন্দ্রীয় শুল্ক বিভাগের সহকারী কালেক্টর ছিলেন পাতালগঙ্গা এলাকার দায়িত্বে। রিলায়ান্সের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানো নোটিস পাঠিয়ে দিলেন তিনি। ওই শোকজ নোটিসে বলা হয়, ১৯৮২ সাল থেকে পলিয়েস্টার উৎপাদনের পরিমাণ কম দেখিয়ে (আন্ডার-রিপোর্টিং) ও উপযুক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিহারের মাধ্যমে প্রায় ২৭ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার রুপি শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে রিলায়ান্স। এ মর্মে ৯ পৃষ্ঠার সংযুক্তিতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। কেন কোম্পানিটিকে ২৭ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার রুপি পরিশোধ করতে বাধ্য করা, কোম্পানির ফ্যাক্টরি বাজেয়াপ্ত করা ও শুল্ক ফাঁকির জন্য বর্ধিত জরিমানা করা হবে না তার পক্ষে যুক্তি দিয়ে কারণ দর্শানোর আদেশ দেওয়া হলো। ভারতের করপোরেট ইতিহাসে তখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ এটি। স্বাভাবিকভাবেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হলো আম্বানির। কিন্তু বাইরে কিছুই প্রকাশ করলেন না। ১৫ নভেম্বরে প্রেস রিলিজের বরাতে বললেন, দুশ্চিন্তা করার কিছুই নেই। এ ধরনের কারণ দর্শানো নোটিস যে কোনো সময়ই দেওয়া হতে পারে। এটা অনেকটা শুল্ক বিভাগের ‘রুটিন ওয়ার্ক’। স্যানডোজ, ওরকে, ভলটাস ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্লোসিভের মতো মুম্বাইয়ের থেন এলাকার অনেক কোম্পানিকেই সম্প্রতি এ ধরনের নোটিস দেওয়া হয়েছে। এটা রাজস্ব বাড়ানোর জন্যই করা হয়ে থাকে। রিলায়ান্সের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো মূলত তত্ত্বীয় হিসাব-নিকাশ ও আনুমানিক তথ্যাদির সমন্বয়ে করা হয়েছে। শিগগিরই এ অভিযোগের বিপরীতে রিলায়ান্সের পক্ষ থেকে যথাযোগ্য যুক্তিতথ্য সমেত জবাব দেওয়া হবে। আশা করা যায়, এ নোটিসে উত্থাপিত দায় থেকে অচিরেই মুক্ত হতে পারবে এ কোম্পানি।

সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের উদ্দেশ্যে এমন আশার বাণী শোনালেও দুশ্চিন্তায় মাথায় আগুন ধরে গেছে আম্বানির। এ গোলযোগের মধ্যে এলো সুখবর। সরকার প্রকৃত উৎপাদকদের পিটিএ আমদানির সাময়িক অনুমতি দিয়েছে। ১৯৮৫ সালের নভেম্বর থেকে পরবর্তী ছয় মাস যতটা প্রয়োজন পিটিএ আমদানি করতে পারবে পলিয়েস্টার প্রস্তুতকারীরা। তবে ডিএমটি ব্যবহারকারী কোম্পানি পিটিএতে রূপান্তর করে পিটিএ আমদানির এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে না। ততদিনে ব্যুরো অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল কস্ট অ্যান্ড পাইস ডিএমটির দামের ওপর একটি গবেষণা চালাবে। তাদের কাজ হবে এমনভাবে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে আমদানিকৃত পিটিএর তুলনায় দেশে উৎপাদিত ডিএমটি যাতে ব্যয় সুবিধা (কস্ট অ্যাডভান্টেজ) পেতে পারে। এ ব্যুরোর পরামর্শ মতে, আমদানির লাইসেন্স পেতে হলে রিলায়ান্সকে হাইকোর্টের মামলা তুলে নিতে হবে। এ পরামর্শ মেনে নেওয়াটাই তখন সুবিধাজনক। ইতোমধ্যেই রিলায়ান্স একাই নয়, নাজেহাল হয়েছে আরও অনেক করপোরেট গ্রুপ। কপল মেহরা জেল খেটেছেন, অপমানিত হয়েছেন। নুসলি ওয়াদিয়াও লোকসান গুনেছেন অনেক। দেশীয় ডিএমটি উৎপাদকদের জন্য সরকার ঘোষিত ট্যারিফ সুবিধা ও কোটা সুরক্ষা সত্ত্বেও তার নতুন প্লান্ট বন্ধ রাখতে হয়েছে টানা কয়েক মাস। কারণ ধীরুভাই সরকারের বিরুদ্ধে লড়ে ঠিকই তার পিটিএর আমদানি দেশে আনতে পেরেছিলেন। আর উৎপাদিত পণ্যে ক্রমাগত উন্নয়নের মাধ্যমে চাহিদাও বাড়িয়ে তুলেছেন অব্যাহতভাবে। ফলে ওয়াদিয়ার ডিএমটি মার্কেটে সেভাবে জায়গা বাড়াতে পারেনি। তাই সবদিক দিয়ে হিসাব করলে অন্য সবার চেয়ে রিলায়ান্সেরই ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে কম।

এরই মধ্যে একজন অন্যতম সহযোগী হারালেন ধীরুভাই। হঠাৎ করেই মারা গেলেন গণযোগাযোগ ও সরকারি লিয়াজোঁ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রশিকভাই মেসওয়ানি। অত্যন্ত বিশ্বস্ত ভাগনেটিকে হারানো আম্বানির যত বড় শোকের ব্যাপার ততটাই লোকসানের। রশিকের জায়গা নিতে পারেÑএমন রিলেশন অফিসার আম্বানি কোথায় পাবেন। নতুন কর্মকর্তার কাছ থেকে আশানুরূপ যোগাযোগ পেতে পরবর্তী কয়েক বছর লেগে গিয়েছিল আম্বানির। রশিকের মৃত্যুর পরপরই তার অভাব তীব্রভাবে অনুভব করলেন আম্বানি। তিনি বুঝলেন এ পর্যন্ত শক্ত হাতে আঘাত সামলে এসেছেন। এখনও অনেক বাধা সামনে ঝুলে আছে অবশ্য। কিন্তু এরই মধ্যে অন্যদের মতো তারও রক্ত ঝরেছে অনেক। এই এক বছরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যতটা পেছনে পড়ে গেছেন, তা সামলাতে হয়তো আরও অনেক কিছুই হারাতে হবে। হার না মানার প্রতিজ্ঞাটি নিজের মনেই আরেকবার ঝালিয়ে নেন আম্বানি।

১৯৮৫ সালে একেবারে শেষদিকে পত্রপত্রিকায় ভারতীয় গণতন্ত্র বিনাশী দানব আখ্যা দিয়ে লেখা শুরু হলো আম্বানির বিরুদ্ধে। বিজনেস ট্যাবলয়েড ব্লিটস্্-এ প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হলো, যদি ধীরুভাইয়ের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো সত্য বলে প্রমাণিত হয়, যদি সত্যিই তিনি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে থাকেন বা পিটিএ আমদানির জন্য দুটি বিদেশি ও তিনটি দেশি ব্যাংকের সহায়তায় ভুয়া লেটার অব ক্রেডিট খুলে থাকেন তাহলে তার অভিসন্ধি বুঝতে আর বাকি থাকে না। তাহলে বলাই যায় যে, মাত্র একজন শিল্পপতি নেই ১৯৬৯ সাল থেকে আক্ষরিক অর্থেই সরকারকে আদেশ করে আসছে কখন কী করতে হবে, কীভাবে টেক্সটাইল ও ইমপোর্ট পলিসির নকশা করতে হবে। একটি মাত্র কোম্পানি মার্কেটে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে একের পর এক প্রতিযোগী কোম্পানিকে বলতে গেলে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নয়, জনগণ মনোনীত ব্যক্তি নয়, কেবল একজন ব্যবসায়ী অর্থের জোরে রাষ্ট্রীয় শক্তিকে নিজের কুক্ষিগত করে তুলেছে। এটিই এখন বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। সবচেয়ে বড় অঙ্কের জরিমানা সমেত শোকজ খেয়েও সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে কোম্পানিটি।

ব্লিটসের এ কথাগুলো ছিল নুসলি ওয়াদিয়ার মনে। তিনি শুধু আশায় ছিলেন ভিপি সিং হয়তো কিছু করবেন। তার মুলো বেশ কাজে দিয়েছে। থলের বেড়াল বের করেছে। কিন্তু এবার লাঠির ব্যবহারটা ঠিকমতো করতে পারবেন তো ভিপি সিং! সিংয়ের সঙ্গে শিল্প-কারখানাবিষয়ক পলিসি বাদে অন্য কোনো ব্যাপারে যোগাযোগ নেই নুসলির। তিনি বরং রাজীব গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখলেন। ঠিক ব্লিটসের ভাষায় অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতি ধরে রাখছিলেন।

ডিসেম্বরে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দ-উৎসবে সারা দেশ থেকে অতিথিরা এসে জড়ো হয়েছেন মুম্বাইয়ে। সবাইকে অবাক করে দিলেন রাজীব। উৎসবকে স্মরণীয় করে রাখতে পার্টির নেতাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেন। কর ফাঁকি দেওয়া শিল্পপতি তালিকা করে আইনের আওতায় আনা হবে। খুঁজে বের করা হবে তাদের সহচর সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদেরও, যারা অবৈধ উপায়ে তাদের সঙ্গে আঁতাত করে, তাদের সুরক্ষার ঢাল হিসেবে কাজ করে। এ গোটা চক্রের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো।

আর এভাবেই যে পলিয়েস্টার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল পাইধোনির সুতার বাজারে, সে যুদ্ধ ছড়িয়ে গেল ভারতের বিস্তৃত রাজনৈতিক অঙ্গনেও।