রহমত রহমান: আয়কর রিটার্ন প্রস্তুতকারী (টিআরপি) নিয়োগে জটিলতা কেটেছে। টিআরপি হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য আবেদনপত্র আহ্বান ও টিআরপি নিয়োগ নিয়ে করা রিট খারিজ করে দেয়া হয়েছে। ১১ জুন হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মাহবুবুর রহমানের দ্বৈত বেঞ্চ এই রিট খারিজ করে দেন। ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) টিআরপি নিয়োগ দিতে পারবে। এর আগে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি রিট করা হয়েছে। বাংলাদেশ ট্যাক্স লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে মহাসচিব খোরশেদ আলম এবং ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ উজ্জামান খান ওই রিট করেন। ১৪ ডিসেম্বর ‘রিটার্ন প্রস্তুতকারী হিসেবে তালিকাভুক্তির কর অভিজ্ঞান পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আবেদন আহ্বান’ করে বিজ্ঞপ্তি দেয় বিসিএস (কর) একাডেমি। এছাড়া ১৩ নভেম্বর ‘আয়কর রিটার্ন প্রস্তুতকারী (টিআরপি) ২০২৩’ প্রকাশ করে এনবিআর। ওই বিজ্ঞপ্তি ও সংশ্লিষ্ট বিধির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এই রিট করা হয়েছে। পরে আদালত তা স্থগিত করে দেন।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতকে বলা হয়, করনেট সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি ও ই-টিআইএনধারীদের রিটার্ন দাখিলের সুবিধার্থে ২০২৩ সালের ২৬ জুন আয়কর রিটার্ন প্রস্তুতকারী (টিআরপি) বিধিমালা, ২০২৩ জারি করা হয়। এই বিধিমালার আলোকে টিআরপি তালিকাভুক্তির জন্য ১৪ ডিসেম্বর আবেদন চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে ১০ হাজার ২৪৭ জন টিআরপি হিসেবে নিবন্ধিত হতে ফিস প্রদান করে আবেদন করেছেন। কিন্তু রিট করার ফলে এসব সাধারণ আবেদনকারীর আকাক্সক্ষা ব্যাহত হয়েছে। তাদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
রিটকারীরা টিআরপি নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন করেছেন, যার উত্তর রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতকে দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন ছিলÑমূল আইনে না থাকা সত্ত্বেও এনবিআর টিআরপি বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। এই এখতিয়ার এনবিআরের আছে কি না? রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জবাবে বলা হয়েছেÑআয়কর আইন, ২০২৩-এর ৩৪৩ ধারায় এনবিআরকে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। বিধিতে বলা হয়েছে, বোর্ড, সরকারি গেজেট ও প্রজ্ঞাপন দ্বারা এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বিধি প্রণয়ন করতে পারবে। আইনের চতুর্থ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যেহেতু আয়কর, অগ্রিম আয়কর, উৎসে কর, ন্যূনতম কর, সারচার্জ ও অন্য কোনো প্রকারের করারোপের ক্ষেত্র বিস্তৃতকরণ, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে যুগোপযোগী ও সময়োপযোগী করে নতুন আইন প্রণয়ন করা আবশ্যক। ফলে বলা যায়, আয়কর রিটার্ন প্রস্তুতকারী বিধিমালা, ২০২৩ প্রণয়নে এনবিআরের এখতিয়ার প্রশ্নাতীত।
প্রশ্ন ছিলÑট্যাক্স হিসেবে আহরিত অর্থ কাউকে প্রণোদনা আকারে প্রদানের এখতিয়ার এনবিআরের আছে কি না? জবাবে বলা হয়েছে, এনবিআর ট্যাক্স হিসাবে আহরিত অর্থ কাউকে প্রণোদনা হিসাবে প্রদান করছে না। আয়কর রিটার্ন প্রস্তুতকারী বিধিমালার বিধি ১২-তে প্রণোদনার যে ছক রয়েছে, তা একটি ফর্মুলা বা গাণিতিক পরিগণনা মাত্র। বিষয়টি এমন নয় যে, কর হিসাবে আহরিত অর্থের একটি অংশ এনবিআর সরকারি কোষাগারে জমা করবে এবং অপর অংশ সরাসরি প্রণোদনা হিসাবে প্রদান করবে। বরং এই প্রণোদনা সরকারের একটি খরচÑসরকারের সব খরচ যেভাবে আর্থিক বিধিবিধান ট্রেজারি রুলস সবকিছু মেনে নির্বাহ করা হয়।
প্রশ্ন ছিলÑসংবিধানের ধারা ৪০-এ যে পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা দেয়া আছে, তারই ধারাবাহিকতায় বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২-এর ১৯(২) এ প্রদত্ত সুযোগ আয়কর রিটার্ন প্রস্তুতকারী বিধিমালার বিধি ৪(২) দ্বারা বারিত করা হয়েছে কি না? জবাবে বলা হয়েছে, টিআরপি বিধিমালা দ্বারা আইনজীবীদের প্র্যাকটিসের সুযোগ বারিত করা হয়নি। টিআরপি বিধিমালা অনুসারে, টিআরপিদের প্রণোদনার প্রাপ্যতা রয়েছে। আয়কর আইনজীবীদের এই প্রণোদনার সুযোগ গ্রহণ করতে হলে বিধি ৪(২) অনুসারে টিআরপি হিসাবে অন্তর্ভুক্তির আবেদন করতে হবে। কারণ শুধু টিআরপিরাই এই প্রণোদনা পাবেন।
প্রশ্ন ছিলÑরিটার্ন দাখিল, কর আদায়, জরিপ, রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দাখিলের বাধ্যবাধকতা, কর গোয়েন্দা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু ধারা, যেমন আয়কর আইন, ২০২৩-এর ধারা ৮, ১৬৬, ২০৫, ২২১, ২৬৪ উল্লেখ পূর্বক পিটিশনারের পক্ষ হতে প্রশ্ন করা হয়। উল্লিখিত ধারাসমূহের কার্যক্রম টিআরপি’র কার্যক্রমের অনুরূপ বিধায় উল্লিখিত ধারায় কার্যক্রম গ্রহণ করলে টিআরপি’র প্রয়োজনীয়তা থাকবে কি না? জবাবে বলা হয়েছেÑবিষয়টি সঠিক নয়। কেননা টিআরপির কাজ হচ্ছে শুধু নতুন করদাতার, অর্থাৎ যিনি প্রথমবারের মতো আয়কর রিটার্ন দাখিল করছেন, তার আয়কর রিটার্ন অনলাইনে দাখিলে সহায়তা করা। রিটার্ন দাখিল, রিটার্ন দাখিলের প্রমাণক উপস্থাপনের বাধ্যবাধকতা, কর গোয়েন্দা কার্যক্রমের মতো জটিল আইনি বিষয়ের সঙ্গে টিআরপি’র কার্যক্রমের কোনো তুলনা চলে না। এসব ধারার সঙ্গে টিআরপি’র কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রশ্ন ছিলÑটিআরপিরা করদাতার কাছ থেকে কোনোরূপ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন কি না? জবাবে বলা হয়েছে, টিআরপিরা করদাতার কাছ থেকে কোনোরূপ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন না। টিআরপি বিধি-১ এ উল্লিখিত টিআরপি’র কর্তব্যসমূহের মধ্যে অর্থদাবি করার কোনো ক্ষমতা রাখা হয়নি। বিধি ১৭(ঘ) এ কোনোরূপ আর্থিক অনিয়মের জন্য টিআরপি সনদ বাতিলের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া টিআরপি সহায়িকায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, টিআরপিরা করদাতাদের কাছ থেকে কোনোরূপ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন না।
প্রশ্ন ছিলÑটিআরপিরা কর আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে পারবেন কি না? জবাবে বলা হয়েছেÑকর আইনজীবীরা যে কোনো করদাতার (ব্যক্তি, কোম্পানি, নতুন ও পুরাতন) যে কোনো আয়কর রিটার্ন প্রস্তুত, যে কোনো পদ্ধতিতে (অনলাইন, অফলাইন) দাখিল এবং শুনানি প্রদানের এখতিয়ার রাখেন। তবে তারা যদি টিআরপি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে চান, শুধু সেক্ষেত্রে একটি আবেদন দিতে হবে, কোনো পরীক্ষা নয়। অপরদিকে টিআরপিরা শুধু নতুন ব্যক্তি করদাতার প্রথম পাঁচ বছরের আয়কর রিটার্ন শুধু অনলাইনে দাখিল করতে পারবেন। আয়কর রিটার্ন প্রস্তুতকারী বিধিমালার বিধি-৬ অনুসারে টিআরপিরা কোনোভাবেই আয়কর আইনের ধারা-৩২৭ অনুযায়ী কর আইনজীবী হিসাবে গণ্য হবেন না। রাষ্ট্রপক্ষ আদালতকে বলেন, এই রুলের ফলে টিআরপি কার্যক্রম বাতিল হলে রাজস্ব আহরণসহ সব সরকারি কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এছাড়া বিধি প্রণয়নে সরকারি দপ্তরগুলোর আইনি ক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। টিআরপি নিয়োগ কার্যক্রম অনেকটা চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী নিয়োগের মতো। আদালত পরে রুল খারিজ করে দেন।