আতাউর রহমান: দেশের পুঁজিবাজারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড চলতি ২০২২-২৩ হিসাববছরের ছয় মাসে (অক্টোবর-মার্চ) প্রায় ৪৪৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এর মধ্যে তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) কোম্পানিটির ৩৯২ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, হুইলিং চার্জ না বাড়া এবং নানা প্রকল্পে বিনিয়োগের কারণে এ লোকসান হয়েছে বলে জানিয়েছে কোম্পানিটি। তবে অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে বেশি লোকসান হওয়ায় বিষয়টি তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগের কারণে ছয় মাসে ৪০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হওয়া অস্বাভাবিক। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ বা কোনো যোগসাজশ রয়েছে কি নাÑসে বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সরকারের পক্ষ থেকে নজরদারি বাড়ানোর বিষয়ে জানান তারা। কোম্পানিটির প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানা গেছে।
কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি হিসাববছরের প্রথম ছয় মাসে কোম্পানির আয় হয়েছে ১ হাজার ২২৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ট্রান্সমিশন খরচ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৬১৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ছয় মাসে কোম্পানির ব্যবসা হয় ৬০৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অন্যান্য খরচ শেষে এ সময় কোম্পানিটির কর পূর্ববর্তী লোকসান দাঁড়ায় ৩০৩ কোটি ৯২ লাখ টাকায়। এদিকে দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানির আয় হয়েছে ৫৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ট্রান্সমিশন খরচ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৩১৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানি ব্যবসা করেছে ২১৬ কোটি ৯১ লাখ টাকার। কোম্পানিটির দ্বিতীয় প্রান্তিকে অন্যান্য খরচ শেষে কর পূর্ববর্তী লোকসান দাঁড়ায় ৪৬৪ কোটি ২৩ লাখ টাকায়। এছাড়া দ্বিতীয় তিন মাসে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী লোকসান হয়েছে ৩৯২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। কিন্তু চলতি হিসাববছরের প্রথম ছয় মাসে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মোট লোকসান হয়েছে ২৮১ কোটি ৫ লাখ টাকা। প্রথম তিন মাসে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয় ১০৪ কোটি ২ লাখ টাকা। সে হিসাবে দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানির লোকসান থেকে প্রথম প্রান্তিকের মুনাফা বাদ দিলে কোম্পানির প্রথম ছয় মাসে উল্লিখিত লোকসান দাঁড়ায়।
গত ২০২১-২২ হিসাববছরের প্রথম ছয় মাসে কোম্পানিটির আয় হয়েছে ১ হাজার ১৬১ কোটি ২২ লাখ টাকা। ট্রান্সমিশন খরচ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৫৫৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। সে সময় কোম্পানির ব্যবসা হয় ৫০৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এছাড়া অন্যান্য খরচ শেষে কোম্পানিটির কর পূর্ববর্তী মুনাফা হয় ২৯৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকার এবং কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছিল ১৯৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকার। সে হিসাবে ২০২২-২৩ হিসাববছরের প্রথম ছয় মাসে আগের বছরের তুলনায় কোম্পানির আয় বেড়েছে ৬৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বা সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ব্যবসা বেড়েছে প্রায় ১০০ কোটি বা সাড়ে ১৯ শতাংশ।
অন্যদিকে কোম্পানিটির ২০২১-২২ হিসাববছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে আয় হয় ৫১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং কোম্পানির ট্রান্সমিশন খরচ বাবদ ব্যয় হয় ২৭৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকার। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটি ব্যবসা করে ২৪০ কোটি ৯৪ লাখ টাকার। এছাড়া কোম্পানিটি অন্যান্য ব্যয় শেষে কর পূর্ববর্তী মুনাফা করে ১১০ কোটি ৩৩ লাখ টাকার এবং কর পরবর্তী নিট মুনাফা করে ৬৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকার। সে হিসাবে ২০২২-২৩ হিসাববছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে আগের বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় আয় বেড়েছে ১৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বা ৩ শতাংশ। আয় বাড়লেও এ সময় কোম্পানির ব্যবসা কমেছে ২৪ কোটি ৩ লাখ টাকা বা প্রায় ১০ শতাংশ। সেই সঙ্গে কোম্পানিটি আগের বছরের তুলনায় চলতি হিসাববছরে কর পূর্ববর্তী অন্যান্য খরচ বাবদ এবং কর পরবর্তী নিট মুনাফার পরিবর্তে লোকসান করেছে। সে হিসাবে কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে কয়েকগুণ।
এদিকে ২০২২-২৩ হিসাববছরের তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানির আয় হয়েছে ৫৪০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা এবং ট্রান্সমিশন খরচ শেষে ব্যবসা হয়েছে ২৬৪ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ সময় কোম্পানির কর-পরবর্তী লোকসান হয় ৪৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং কর-পরবর্তী লোকসান হয়েছে ৫০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এছাড়া চলতি হিসাববছরের নয় মাসে কোম্পানির আয় হয়েছে ১ হাজার ৭৬৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং ট্রান্সমিশন খরচ শেষে ব্যবসা হয়েছে ৮৭১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির অন্যান্য খরচ শেষে কর পূর্ববর্তী লোকসান হয় ৩৫১ কোটি ১৭ লাখ টাকা এবং কর-পরবর্তী লোকসান হয়েছে ৩৩১ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
সে হিসাবে কোম্পানিটির চলতি হিসাববছরের নয় মাসের শেষ ছয় মাসে মোট লোকসান হয়েছে ৪৪৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা এবং এ সময় কোম্পানির মোট লোকসান থেকে নয় মাসের প্রথম তিন মাসে হওয়া মুনাফা বাদ দিলে লোকসান দাঁড়ায় ৩৩১ কোটি ৯১ লাখ টাকায়।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলেন, কোম্পানির চার্জ না বাড়লেও তো আয় কমেনি। সেই সঙ্গে ডলারের দাম বাড়লে কি এত বেশি লোকসান হতে পারে? প্রথম ছয় মাসে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার লোকসান আর তৃতীয় প্রান্তিকে ৫০ কোটি টাকার। তিন মাসের ব্যবধানে লোকসানের পার্থক্যও অনেক। তাই কোম্পানিটি মানুষকে কষ্ট দিয়ে চার্জ বৃদ্ধি করতে ও জনগণের খরচ বাড়াতে এবং বেশি লোকসান দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অর্থ আত্মসাতের কোনো পাঁয়তারা করছে কি না, সে বিষয়ে তদন্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে যারা কারসাজির সঙ্গে যুক্ত থাকবে এবং প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতি: দায়িত্ব) মো. মাসুম আলম বকসী শেয়ার বিজকে বলেন, অন্যান্য কোম্পানির ট্যারিফ চার্জ বাড়লেও আমাদেরটা বাড়েনি। আমাদের সেই আগের হুইলিং চার্জ আছে। সেই সঙ্গে ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্যান্য কোম্পানির মতো আমাদেরও অনেক লোকসান হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ থাকায় আরও লোকসান হয়েছে বলে তিনি জানান।
পরে তিনি বিস্তারিত জানতে কোম্পানির অর্থ বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগযোগ করতে বলেন। এজন্য শেয়ার বিজ থেকে কোম্পানিটির অর্থ বিভাগের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।