আয়-মুনাফা বাড়লেও ব্যাংকগুলো ঠকাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের

আতাউর রহমান: দেশের ব্যাংকিং খাতের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের আয় ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ শেষে বেড়েছে। সেই সঙ্গে মুনাফাও বেড়েছে অনেক ব্যাংকের। ফলে বছর শেষে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো গত বছরের তুলনায় লভ্যাংশ বেশি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও সাতটি ব্যাংকের আয় গত বছরের তুলনায় বাড়লেও লভ্যাংশ কম ঘোষণা করা হয়েছে। এতে ব্যাংকের আয় বাড়লেও শেয়ার প্রতি মুনাফা বাড়েনি বিনিয়োগকারীদের। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগকারীদের ঠকাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানা গেছে।

যেসব ব্যাংক ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে লভ্যাংশ কম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুলো হলোÑসিটি ব্যাংক, ডাচবাংলা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক।

ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সমাপ্ত বছরে সিটি ব্যাংকের পরিচালন আয় আগের বছরের তুলনা ২৬৫ কোটি টাকা বা সাড়ে ১১ শতাংশ বেশি হয়েছে। গত বছর ব্যাংকটির পরিচালন আয় হয়েছে মোট প্রায় ২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা, আগের বছর (২০২১ সালে) হয়েছে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। কিন্তু কর-পরবর্তী ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে ১৭১ কোটি টাকা বা ২৬ শতাংশের বেশি। এর কারণ হচ্ছেÑব্যাংকটিকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে গত বছরের তুলনায় বেশি প্রভিশন রাখতে হয়েছে। ব্যাংকটি সমাপ্ত হিসাব বছরে আগের বছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ কম লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ১০ শতাংশ নগদ ও ২ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, আগের বছর দিয়েছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ ও ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বোনাস।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিনিয়ত ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য সংকট, খেলাপি ঋণসহ নানা অনিয়মের কারণে এখন ধুঁকে ধুঁকে চলছে। এরপরও কভিড মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে অনেক ব্যাংক ভালো ব্যবসা করছে। এতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর প্রতি সবার নজর বেশি থাকে। ব্যাংকগুলো ভালো ব্যবসা করলে বিনিয়োগকারীরা একটু বেশি মুনাফার আশা করেন। ফলে যারা ব্যাংকে এফডিআর না করে বাজারে ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ করেন তারা বছর শেষে একটি ভালো লভ্যাংশ পাওয়ার আশা করেন। সেই সঙ্গে যে ব্যাংক ভালো ব্যবসা করে এবং ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা করে সে ব্যাংকের শেয়ারদর বৃদ্ধিতে শেয়ার থেকেও বিনিয়োগকারী মুনাফা করে থাকেন। কিন্তু ব্যাংকগুলো যদি ভালো আয় ও মুনাফা করেও আগের বছরের তুলনায় কম লভ্যাংশ দেয় তবে দুই দিক থেকেই বিনিয়োগকারীকে ঠকানো হবে। শেয়ারে বিনিয়োগ করে কম লভ্যাংশ পাবে, আবার কম লভ্যাংশ দেয়ায় শেয়ারের দাম কমে যাবে।

এছাড়া উল্লেখিত বাকি ব্যাংকগুলোর পরিচালন আয়ের সঙ্গে নিট মুনাফা বাড়লেও চলতি বছর লভ্যাংশ কম দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ডাচবাংলা ব্যাংকের পরিচালন আয় বেড়েছে ৩৭৪ কোটি টাকা বা ১৩ শতাংশের বেশি। আর নিট মুনাফা বেড়েছে ১০ কোটি টাকা বা প্রায় ২ শতাংশ। কিন্তু ব্যাংকটি বিনিয়োগকারীদের আগের বছরের তুলনায় আড়াই শতাংশ লভ্যাংশ কম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ ও ৭ দশমিক ৫ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, আগের বছর দিয়েছিল ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস।

আলোচিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে গত বছর এনসিসি ব্যাংকের পরিচালন আয় বেড়েছে প্রায় ৯৪ কোটি টাকা বা ৮ শতাংশ। আলোচ্য হিসাব বছরে ব্যাংকটির নিট মুনাফা বেড়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা বা ১ শতাংশের বেশি। কিন্তু ব্যাংকটি বিনিয়োগকারীদের আগের বছরের তুলনায় ৬ শতাংশ লভ্যাংশ কম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, আগের বছর যা ছিল ১২ শতাংশ নগদ এবং ৪ শতাংশ বোনাস।

এদিকে গত বছর প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৩৭৩ কোটি টাকা বা সাড়ে ২৫ শতাংশের বেশি পরিচালন আয় বেড়েছে। আলোচ্য হিসাব বছরে ব্যাংকটির ৭৬ কোটি টাকা বা ২৩ শতাংশের বেশি নিট মুনাফা বেড়েছে। কিন্তু ব্যাংকটি সমাপ্ত হিসাব বছরে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ নগদ ও ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণার মাধ্যমে আগের বছরের থেকে আড়াই শতাংশ কম লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। আগের বছরে ব্যাংকটি ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ নগদ এবং ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে।

এছাড়া স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৩৪ কোটি টাকা বা ৪৪ শতাংশের বেশি নিট মুনাফা বেড়েছে। কিন্তু ব্যাংকটি সমাপ্ত হিসাব বছরে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ নগদ ও ২ দশমিক ৫০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণার মাধ্যমে আগের বছরের থেকে ১ শতাংশ কম লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। আগের বছরে ব্যাংকটি ৩ শতাংশ নগদ এবং ৩ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে।

অপরদিকে ট্রাস্ট ব্যাংকের গত বছর পরিচালন আয় বেড়েছে ৪৩ কোটি টাকা বা আড়াই শতাংশের বেশি। আলোচ্য হিসাব বছরে ব্যাংকটির নিট মুনাফা বেড়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা বা সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি। কিন্তু ব্যাংকটি বিনিয়োগকারীদের আগের বছরের চেয়ে আড়াই শতাংশ লভ্যাংশ কম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ১০ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, আগের বছর যা ছিল ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ নগদ এবং ১০ শতাংশ বোনাস।

এছাড়া ইউনিয়ন ব্যাংকের গত বছর পরিচালন আয় বেড়েছে ৯১ কোটি টাকা বা প্রায় ১৪ শতাংশ। আর নিট মুনাফা বেড়েছে ৬৪ কোটি টাকা বা প্রায় সাড়ে ৭৩ শতাংশ। কিন্তু ব্যাংকটি বিনিয়োগকারীদের আগের বছরের চেয়ে ৫ শতাংশ লভ্যাংশ কম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, আগের বছর দিয়েছিল ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, বর্তমানে পুঁজিবাজারে ব্যাংক খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, ব্যাংকগুলো মুনাফা করে কম লভ্যাংশ ঘোষণা করে। কোনো কোনো ব্যাংক নগদ পুরোটাই নিজের কাছে রেখে শুধু বোনাস লভ্যাংশ দেয়। ফলে ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগের চেয়ে অন্য খাতে বিনিয়োগ বেশি লাভজনক। কিন্তু ব্যাংকগুলো যদি মুনাফার সর্বোচ্চ লভ্যাংশ দেয়, তবে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন তারা। এতে দীর্ঘ সময়ে যারা বিনিয়োগ করেন তারা এফডিআর না করে ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ করে দুইভাবেই লাভবান হবেন বলে জানান তারা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০